বুলু মাথা নাড়ল।
খা, অসুবিধা কিছু নাই। এখন টাকা দিতে হবে না।
না, আর কিছু না। সিগারেট দে। আছে?
আছে।
বুলু চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানতে লাগল। বুলুর চেহারাটা চমৎকার। ফর্সা গায়ের রঙ। মেয়েদের মতো চিবুক। বড় বড় চোখ। তাকে দেখলেই মনে হয় সিনেমার কোনো নায়ক বেকার যুবকের ভূমিকায় পার্ট করছে।
বুঝলি সোবাহান, মামির জন্যে টিকে আছি। মামির দিকে তাকিয়েই ওই শালাকে খুন করতে পারছি না।
তুই এখন কী করবি?
কিছু করব না। সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরব। এর মধ্যে মামা কিছুটা ঠান্ডা হবে আশা করা যায়।
সন্ধ্যা হতে তো দেরি আছে।
এতক্ষণ কী করবি? আমার সঙ্গে চল।
না, তোর ওখানে যাব না। ঘরটা ভালো না। ঢুকলেই দম বন্ধ হয়ে আসে। আসি। আমি কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করব।
টাকাপয়সা আছে তোর কাছে?
না।
দশটা টাকা নে আমার কাছ থেকে।
আরে না, টাকা থাকলেই খরচ হয়ে যাবে। তুই বরং এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দে। আমার একটা বাকির দোকান ছিল। ব্যাটার ভগ্নিপতি মারা গেছে। দোকান বন্ধ করে গেছে দেশে।
বুলু উঠে দাঁড়াল। সোবাহান তাকে এগিয়ে দিতে গেল। বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত তারা হাঁটল নিঃশব্দে। বুলুর মুখে গাঢ় দুশ্চিন্তার রেখা। হাঁটছে মাথা নিচু করে। সোবাহান বলল, আমার সঙ্গে এসে কিছুদিন থাকতে পারিস। থাকবি?
আরে না।
আমার সঙ্গে দেশে যাবি? কয়েকদিন থেকে আসব।
বুলু জবাব দিল না।
জায়গাটা ভালো। তোর পছন্দ হবে।
বুলু সিগারেট ধরাল। তার সম্ভবত কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
রহমান সাহেব আজ অফিসে
রহমান সাহেব আজ অফিসে এসেছেন। তার পিএ বলে দিয়েছে এগারোটায় একটা বোর্ড মিটিং আছে, মিটিংয়ের আগে বড় সাহেব কারও সঙ্গে দেখা করবেন না। সোবাহান জিজ্ঞেস করল, বোর্ড মিটিং শেষ হতে কতক্ষণ লাগবে?
পিএটি বিরক্ত মুখে বলল, তা কী করে বলব? কী কী এজেন্ডা আছে তার ওপর ডিপেন্ড করে। লাঞ্চ টাইমের আগেই শেষ হবে। লাঞ্চের পরে আসেন। এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন না।
সোবাহান তবু খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এই মেয়েটির কথাবার্তায় অপমান করার চেষ্টা আছে। অথচ কেমন ভদ্র, বড় বোন বড় বোন চেহারা!
এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। কাজের ক্ষতি হয়। ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসুন।
একটা স্লিপ কি দয়া করে পাঠাবেন? আমার সঙ্গে তার আগে কথা হয়েছে। উনি আমাকে চিনেন।
চিনলেও কোনো কাজ হবে না। বোর্ড মিটিংয়ের আগে তিনি কারও সঙ্গে দেখা করবেন না। আপনি নিচে গিয়ে বসুন। এক কথা কবার বলব!
সোবাহান নিচে নেমে এল। রিসিপশনের মেয়েটি আজ একটা আগুন রঙের সিল্কের শাড়ি পরে এসেছে। তাকে চেনাই যাচ্ছে না। মেয়েদের সৌন্দর্যের বেশির ভাগই বোধহয় তাদের শাড়ি গয়নায়। সোবাহান এগিয়ে এসে পরিচিত ভঙিতে হাসল। মেয়েটি তাকাল অবাক হয়ে। সোবাহানকে কি চিনতে পারছে না? গতকালই তো অনেকক্ষণ কথাবার্তা হয়েছে। মেয়েটি বলল, আপনি কি আমাকে কিছু বলছেন?
জি-না। আমি রহমান সাহেবের কাছে এসেছি।
উনি খুব সম্ভব বোর্ড মিটিং-এ আছেন। উনার পিএ বসেন দোতলায়। রুম নম্বর ৩০২।
উনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। ও আচ্ছা।
মেয়েটি একটি টেলিফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সোবাহানকে সত্যি সত্যি চিনতে পারছে না? অপমানিত হওয়ার মতো ব্যাপার। সোবাহানের কান ঝা ঝা করতে লাগল।
আমি গতকাল এসেছিলাম। আপনি বলেছিলেন আজ আসতে।
আমার মনে আছে। আপনি থাকেন শ্যামলীতে। বসুন ওখানে।
সোবাহান বসে রইল।
রহমান সাহেব একটার সময় লাঞ্চ খেতে গিয়ে আর ফিরলেন না। পিএটির সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। তবু তিনটার দিকে সোবাহান গেল তার কাছে। মেয়েটি শুকনো গলায় বলল, দুটোর দিকে তো চলে গেছেন।
আজ আসবেন কি আসবেন না বলে যাননি?
আমাকে বলে যাবেন কেন? আমি কি এখানকার হেড মিসট্রেস? উনি কখন আসবেন না আসবেন সেটা তার ব্যাপার।
এমন ভদ্র চেহারা মেয়েটির। শালীন পোশাকআশাক, অথচ কথাবার্তা বলছে। ছোটলোকের মতো। সোবাহান কিছু বলবে না বলবে না ভেবেও বলে বসল, ভদ্রভাবে বলেন।
ভদ্রভাবে কথা বলব মানে?
মেয়েটি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। সোবাহান শান্তস্বরে বলল, আপনার কথাবার্তা রাস্তার মেয়েদের মতো।
তার মানে? তার মানে?
মেয়েটি রাগে কাঁপছে। তার পাশের টেবিলের বুড়ো মতো ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। ভয় পাওয়া গলায় ডাকলেন, সবুর মিয়া, সবুর মিয়া।
সবুর মিয়া ঢুকল না। সোবাহান ভারী গলায় বলল, ভবিষ্যতে আর এরকম ব্যবহার করবেন না।
আপনি কি আমাকে মারবেন নাকি?
নাহ। মেয়েদের গায়ে আমি হাত তুলি না। ছেলে হলে এক চড়ে মাঢ়ির দুটো দাঁত নড়িয়ে দিতাম।
মেয়েটির গাল গোলাপি বর্ণ ধারণ করল। সোবাহান ঘর থেকে বেরিয়ে এল। খুব সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নিচে গেল। তার ভয় করছিল হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকজন এসে তাকে ধরে ফেলবে। কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। শুধু বুড়োটি পিছু পিছু নেমে এল। সে তাকাচ্ছে ভয় পাওয়া চোখে। তাকে কি গুণ্ডাদের মতো লাগছে?
রিসিপশনের মেয়েটি টেলিফোনে খুব হাসছে। সকালবেলা তাকে যতটা রূপসী মনে হচ্ছিল এখন আর ততটা মনে হচ্ছে না। সোবাহান তার দিকে তাকিয়ে পরিচিত ভঙিতে হাসল। মেয়েটি টেলিফোনে কথা বলা বন্ধ রেখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল তার দিকে। যেন সে বিস্মিত। কিন্তু বিস্মিত হওয়ার কী আছে? একজন মানুষ কি আরেকজন মানুষের দিকে তাকিয়ে হাসবে না!