যূথি নিঃশব্দে ভেতরে চলে গেল। ফরিদ আলি বললেন, আপনার স্ত্রীর কী অসুখ?
মনসুর সাহেব বিরক্তিতে ভ্রূ কুঁচকালেন।
মাথা খারাপ। মাথার দোষ।
তাই বুঝি?
জি। খুব অশান্তিতে আছি।
কথাটা বলেই মনসুর সাহেবের মনে হলো এটা ঠিক হলো না। তিনি শুকনো গলায় বললেন, তবে ভাই বংশগত নয়। টাইফয়েডের পর এরকম হয়েছে। তাদের বংশে পাগল নাই।
অসুখবিসুখের ওপর মানুষের হাত নাই।
পান খাবেন ফরিদ সাহেব?
জি-না, আমি পান-তামাক কিছু খাই না।
সুফি মানুষ আপনারা।
মনসুর সাহেব একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার শব্দ শোনা যেতে লাগল। বড় বিরক্তিকর ব্যাপার। মনসুর সাহেব গলাখাঁকারি দিলেন।
কোনো লাভ হলো না। কান্নার শব্দ বাড়তে লাগল। ফরিদ আলি বসে আছেন চুপচাপ। যেন তাঁর উঠবার কোনো তাড়া নেই। বসে থাকবার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সহজে উঠবেন না।
ফরিদ সাহেব!
জি।
রাত কত হয়েছে?
জানি না, আমার কাছে ঘড়ি নাই।
মনসুর সাহেব বিরক্তিতে ভ্রূ কুঁচকালেন। এই লোক সহজ ইংগিতও ধরতে পারছে। খাল কেটে কুমির আনা একেই বলে। দিব্যি পা উঠিয়ে চেয়ারে বসে আছে। অবিবেচক মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে এত বেশি কেন? মনসুর সাহেব কর্কশ গলায় বললেন, যূথি, পান দিতে হবে না? ফরিদ আলি বললেন, পান আমি খাই না।
আপনার জন্যে না। আমার নিজের জন্যে।
ও আচ্ছা।
ফরিদ আলি আবার নিঃশব্দ হয়ে গেলেন। তিনি কি আজ সারা রাতই এভাবে বসে কাটাবেন?
.
যুঁথি ঘুমোতে যায় অনেক রাতে। এ বাড়িতে কোনো কাজের লোক নাই। রান্নাঘর গুছিয়ে উঠতেই অনেক সময় লাগে। সে দ্রুত কিছু করতে পারে না। তার ওপর তার পরিষ্কারের বাতিক আছে। সবসময় মনে হয় ঠিকমতো ধোয়া হলো না বুঝি। প্লেটের কোথাও বুঝি সাবানের ফেনা লেগে আছে।
আজও সব কাজ সারতে সারতে রাত একটা বেজে গেল। যূথি ঘুমোতে যাওয়ার আগে একবার খোঁজ নিতে গেল মনসুর সাহেবের কিছু লাগবে কিনা। মনসুর সাহেবের অনিদ্রা রোগ আছে। তিনি অনেক রাত পর্যন্ত জাগেন। আজও জেগে ছিলেন। যূথিকে ঢুকতে দেখে চোখ তুলে তাকালেন।
দুলাভাই, কিছু লাগবে?
না, কিছু লাগবে না। ঘুমাও নাই এখনো?
যূথি সরু চোখে তাকিয়ে রইল। মনসুর সাহেবের গলার স্বর অনেকখানি নেমে এসেছে। যূথি অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। মাঝে মাঝে মনসুর সাহেব এরকম নরম স্বর বের করেন। সেটা হয় মধ্যরাতের দিকে।
যূথি!
জি।
তোমার আপা ঘুমাচ্ছে নাকি?
জি।
আমার জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেল, বুঝলে যূথি। সংসার করা কাকে বলে জানলামই না।
যুঁথি উঠে দাঁড়াল। মনসুর সাহেব বললেন, বসো না আরেকটু।
যুঁথি দাঁড়িয়ে রইল। কী করবে সে বুঝতে পারছে না। দুলাভাই অন্যরকমভাবে তাকাচ্ছেন।
রাত হয়ে গেছে। আমি যাই দুলাভাই।
যুঁথি ঘুমায় তার বড় বোন কদমের সঙ্গে। মনসুর সাহেব তার স্ত্রীর সঙ্গে ঘুমান না। সোজাসুজিই বলেন–মাথার ঠিক নাই তার, কোন সময় কী করবে ঠিক আছে? হয়তো ঘুমের মধ্যেই চোখ গেলে দিবে। তখন?
তার ভয়টা অমূলক। কদমের অসুস্থতা সে পর্যায়ের নয়। সে প্রায় সময়ই কাঁদে। এবং বাকি সময়টা সিডেটিভের কল্যাণে ঘুমায়। যূথি এসে ডাকল–আপা, ঘুমিয়েছ?
না।
ক্ষিধে লেগেছে? কিছু খাবে?
না।
মাথায় হাত বুলিয়ে দেব আপা?
দে।
যুঁথি বাতি নিভিয়ে কদমের পাশে এসে বসল। চুল টেনে টেনে দিতে লাগল। কদম বলল, দাড়িওয়ালা লোকটা কে? কী জন্যে এসেছিল?
দাওয়াত খেতে এসেছিল।
দাওয়াত খেতে এল কেন?
যুঁথি জবাব দিল না। কদমও জবাবের অপেক্ষা করল না। ঘুমিয়েও পড়ল না। যূথির ঘুম আসছিল না। সে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইল। বারান্দায় দুলাভাই হাঁটাহাঁটি করছেন। তিনি একবার দরজার পাশে এসে ডাকলেন–বৃথি, বৃথি। যূথি জবাব দিল না। বেশ গরম, তবু সে একটা কাঁথা পর্যন্ত টেনে দিল। তার মনে হলো সেও বোধহয় আপার মতো একসময় পাগল হয়ে যাবে। এটা তার প্রায়ই মনে হয়।
.
০৫.
সোবাহান ঘুমিয়ে ছিল। বুলু এসে তাকে ডেকে তুলল–কিরে, অবেলায় ঘুমাচ্ছিস কেন?
সোবাহান কিছু বলল না। বুলু বলল, ওইদিন সাতসকালে কোথায় গিয়েছিলি?
চাকরির ব্যাপারে।
কী রকম বুঝলি, আশা আছে?
হুঁ।
বুলুর মুখ উজ্জ্বল হলো মুহূর্তেই। হাসিমুখে বলল, তোরটা হলেই আমারটা হবে। রাশির একটা ব্যাপার আছে। আমাদের দুজনের সবকিছু একসঙ্গে হয়। ঠিক না?
সোবাহান জবাব দিল না। বুলু বলল, এরকম গম্ভীর হয় আছিস কেন? শরীর খারাপ?
না, শরীর ঠিকই আছে।
অবেলায় ঘুমোচ্ছিলি কেন?
এ ছাড়া করবটা কী?
সোবাহান কাপড় পরতে শুরু করল। লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরল। বুলু বিস্মিত হয়ে বলল, বেরুচ্ছিস নাকি?
হ্যাঁ।
কোথায়?
চা খেতে। ওই মোড়ের দোকানে চা খাব। মাসকাবারি ব্যবস্থা আছে। চল যাই।
চা খাব নারে। ভাত খাব। ক্ষিধে লেগেছে।
সোবাহান কিছু বলল না। বুলু বলল, খাওয়া হয় নাই। মামার সঙ্গে একটা ফাইটিং হয়ে গেল।
তাই নাকি?
হুঁ। চোর টোর বলল। মামিকে বলে গেছে–আমাকে ভাত দিলে তিন তালাক হয়ে যাবে। চিন্তা কর অবস্থা!
বলিস কী?
কেলেংকারি কাণ্ড। মামি কাঁদছে। বাচ্চাগুলি কাঁদছে।
বাচ্চারা কাঁদছে কেন?
সবচেয়ে ছোটটাকে মামা একটা কিক বসিয়ে দিয়েছে। রাগলে তার মাথা ঠিক থাকে না। মহা ছোটলোক। একদিন শুনবি শালাকে আমি খুন করে ফেলেছি।
বুলু তিন প্লেট ভাত খেয়ে ফেলল। সোবাহান বলল, আর কিছু খাবি? দৈ মিষ্টি?