কিন্তু ফিরে যাওয়া হচ্ছে না। দেখতে দেখতে এখানেও তিন মাস হয়ে গেল। আরও কিছুদিন গেলে এ জায়গাটার ওপরও একটা মায়া পড়ে যাবে। ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করবে না। মায়া বড় সাংঘাতিক জিনিস।
.
০৩.
দশটায় আসার কথা সোবাহান নটায় এসেছে। বসার জায়গাটা ভালো। বেতের গদিওয়ালা চেয়ার ইউ আকৃতিতে সাজানো। মাঝখানে বেমানান আধুনিক একটা কাঁচের টেবিল। টেবিলের ওপর দু’টি অ্যাশট্রে–এত সুন্দর দেখতে যে, গোপনে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলার ইচ্ছা বহু কষ্টে দমন করতে হয়। দেয়ালে তিনটি বিভিন্ন মাপের তেলরঙ ছবি। প্রতিটিই দেখতে কুৎসিত। ফ্রেমগুলির জন্যেই বোধ করি ওদের সহ্য করা যায়। সোবাহান মাঝখানের একটি চেয়ারে দুপুর বারোটা পর্যন্ত বসে রইল। এর মধ্যে তিনবার। উঠে বারান্দায় গেল থুথু ফেলতে। আজ কেন জানি মুখে ক্রমাগত থুথু জমছে। বারোটার। সময় জানা গেল যার জন্যে বসা থাকা সেই এস. রহমান সাহেব আজ আসবেন না। তার। শরীর খারাপ। সোবাহান ইনকোয়ারিতে বসে থাকা বেঁটে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, কাল আসব? মেয়েটি হাসিমুখে বলল, প্রয়োজন থাকলে নিশ্চয়ই আসবেন।
রহমান সাহেব কি কাল আসবেন?
শরীর ভালো হলে আসবেন। আপনি কি চা খেয়েছেন?
সোবাহান চমকায়। চায়ের কথা আসছে কোত্থেকে? মেয়েটি শান্তস্বরে বলল, যে সব গেস্ট এখানে অপেক্ষা করেন তাদের চা দেওয়ার নিয়ম আছে, আপনাকে দেয় নাই?
জি-না। তাছাড়া আমি গেস্ট না। আমি চাকরির খোঁজে এসেছি।
মেয়েটি কৌতূহলী হলো। ফোন বাজছিল সে সেদিকে লক্ষ না করে বলল, রহমান সাহেব আপনাকে চাকরি দেবেন এমন কিছু বলেছেন?
না, দেখা করতে বলেছেন।
মেয়েটি টেলিফোন তুলে কাকে যেন ইশারা করল। এক কাপ চা এবং এক পিস ফুট কেক এসে পড়ল। চমৎকার ফুট কেক। চা-টাও বেশ ভালো। চিনি কম। কিন্তু চিনি দিতে বলাটা নিশ্চয়ই ঠিক হবে না। মেয়েটি টেলিফোন নামিয়ে খুব মিষ্টি করে বলল, খান, কেক খান। কাল কি আসবেন?
জি।
উনি অবশ্যি ইচ্ছা করলে চাকরি দিতে পারেন। আপনি এখন কোনো চাকরি টাকরি করছেন?
না।
থাকেন কোথায়?
শ্যামলী।
কথাবার্তা আর হলো না। আবার একটি টেলিফোন এল। মেয়েটি অবিকল ইংরেজদের মতো গলায় ইংরেজি বলতে লাগল। মাঝে মাঝে চাপা হাসি। যে চা কেক। খাইয়েছে তাকে কিছু না বলে চলে যাওয়া যায় না। সোবাহান অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু কথা শেষ হচ্ছে না। সোবাহান আন্দাজ করতে চেষ্টা করল যার সঙ্গে কথা হচ্ছে সে ছেলে না মেয়ে। মেয়েই হবে। ছেলেরা এত সময় কথা বলতে পারে না।
বাথরুমে যাওয়া প্রয়োজন। জিজ্ঞেস করবে কাকে? রিসিপশনের মেয়েটির চেহারা মন্দ নয়। ফর্সা মেয়েরা একটু বেঁটে হলেও খারাপ লাগে না। কিন্তু কালো ও বেঁটে এ দুয়ের কম্বিনেশন ভয়াবহ। কালো মেয়েদের লম্বা হতে হয় এবং লম্বা চুল থাকতে হয়।
মেয়েটি টেলিফোন নামিয়ে রেখে তরতর করে দোতলায় উঠে গেল। আর নামার নাম নেই। সোবাহান আরও পঁচিশ মিনিটের মতো অপেক্ষা করল। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। সেজন্যেই মাথায় এখন চাপা যন্ত্রণা হচ্ছে। বাসায় ফিরে টেনে একটা ঘুম দিতে হবে। রিসিপশনিস্ট মেয়েটির নাম কী কে জানে। মাঝে মাঝে সুন্দরী মেয়েদের কুৎসিত সব নাম থাকে। মুন্সিগঞ্জের এসডিও সাহেবের একটি মেয়ে ছিল জলপরীর মতো। নাম তাসকিন। কোনো মানে হয় না। একজন সুন্দরী মেয়ের সুন্দর একটা নাম থাকা দরকার। তাসকিন ফাসকিন নয়, ওর নাম হওয়া উচিত বিপাশা কিংবা জরী।
রিসিপশনিস্ট মেয়েটি নেমে এসে ভ্রূ কুঁচকে বলল, আপনি এখনো যাননি?
জি-না। আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি।
কেন? আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন কেন?
আপনি যত্ন করে চা খাওয়ালেন। না বলে চলে যাই কীভাবে?
যত্ন করে চা খাওয়ালেন মানে? এখানে যে আসে তাকেই চা খাওয়ানো হয়।
সোবাহান বিস্মিত হয়ে বলল, আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন?
মেয়েটি কোনো উত্তর দিল না। সুন্দরী মেয়েরা অকারণে রাগে। এই মেয়েটি যদি কালো, রোগা হতো এবং তার মুখে যদি বসন্তের দাগ থাকত তাহলে সোবাহানের কথায় সে খুশিই হতো। খুশি হওয়ার মতোই কথা।
একজন মোটামুটি সুদর্শন যুবক অপেক্ষা করছিল। হতে পারে যুবকটি চাকরিপ্রার্থী। কাপড়চোপড় ভালো নয়। সারা রাত অঘুমো থাকায় চোখেমুখে ক্লান্তি, তাতে কিছু যায় আসে কি? কিছুই যায় আসে না।
.
সোবাহানকে দেখেই জলিল সাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন, কোথায় ছিলেন সারা দিন? আপনার ভাই এসে বসে আছেন সকাল থেকে।
সোবাহান উৎসাহ দেখাল না। তার ভাই মাসে একবার করে আসেন। তার আসা এমন কোনো বড় ব্যাপার নয়।
ভাত খেতে গেছেন রশীদের হোটেলে। ওইখানে দেখা পাবেন।
সোবাহান ধীরেসুস্থে জামা কাপড় খুলল। গা ঘামে চট চট করছে। জলিল সাহেব বললেন, পানি নাই, গোসল করতে পারবেন না।
পানি নাই?
এক বালতি ছিল–আপনার ভাই শেষ করেছেন। গ্রামের মানুষ বেশি পানি ছাড়া গোসল করতে পারে না। আমি বলেছিলাম আধা বালতি খরচ করতে।
আপনি আজ অফিসে যান নাই?
নাহ। ঘুম থেকেই উঠলাম সাড়ে এগারোটায়। নাস্তা টাস্তা কিছুই করি নাই। একবার ভাবলাম আপনার ভাইর সঙ্গে যাই, চারটা খেয়ে আসি।
গেলেন না কেন?
ভাতের কথা মনে উঠতেই বমি ভাব হলো, বুঝলেন।
কিছুই খান নাই?
পানি খেয়েছি দু’গ্লাস।
সোবাহান গা-ভর্তি ঘাম নিয়ে চৌকির ওপর বসে রইল। এ বাড়িতে পানির বড় কষ্ট। রাত আটটার আগে পানি পাওয়ার আজ আর আশা নাই।