মেয়েটি শান্তস্বরে বলল, আমি। আপনাদের ওঘর থেকে শোনা যায় আমি বুঝতে পারিনি।
শোনা গেলে কাঁদতে না?
যূথি জবাব দিল না। সোবাহান একবার ভাবল জিজ্ঞেস করে, কেন কাঁদ? জিজ্ঞেস করা হলো না। কত রকম দুঃখ আছে মানুষের। সেসব জানতে চাওয়া ঠিক না।
যূথি, যাই। কষ্ট দিলাম তোমাকে। যাও খেতে, খেয়ে নাও।
বুলুর অবস্থা এতটা খারাপ
বুলুর অবস্থা এতটা খারাপ হয়েছে সোবাহান বুঝতে পারেনি। সে অবাক হয়ে ডাকল, এই বুলু! এই!
বুলু ঘোলা চোখে তাকাল।
এ কী অবস্থা তোর?
অবস্থা কেরাসিন। হালুয়া টাইট।
হয়েছে কী?
জণ্ডিস।
জণ্ডিসে এরকম হয় নাকি?
অভাগাদের হয়।
বুলু চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঘুমিয়ে পড়ল বোধহয়। সোবাহান বেডের পাশে রাখা টুলে বসে রইল চুপচাপ। এখন ভিজিটিং আওয়ার নয়। তবু অনেক লোকজন চারদিকে ঘুরঘুর করছে। কোণার দিকে একটি রোগীকে ঘিরে আছে ছ’সাতজনের একটি দল। দু’টি অল্পবয়স্ক মেয়ে আছে। ওরা খিলখিল করে হেসে উঠছে বারবার। বুলুর সাড়াশব্দ নেই।
এই বুলু, এই।
কী?
জেগে ছিলি নাকি?
হুঁ। রেস্ট নিচ্ছিলাম। বেশিক্ষণ কথা বলতে পারি না।
রেশমা এসেছিল?
হ্যাঁ। কাল সারা দিনই ছিল।
আজ আসবে না?
কী জানি। কেন?
এমনি জিজ্ঞেস করলাম। লাগছে কেমন তোর?
ভালোই। কাল রাতে তোর বড়ভাইকে স্বপ্নে দেখলাম।
সোবাহান বিস্মিত হলো। বুলু টেনে টেনে বলল, দেখলাম যেন তোর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি। তোর ভাই গাছের নিচে বসে শান্তির কথা টথা বলছে। দাড়ি চুল সব মিলিয়ে তাকে রবীন্দ্রনাথের মতো লাগছে।
সোবাহান চুপ করে রইল। বুলু ফিসফিস করে বলল, শান্তি ব্যাপারটা কী তোর ভাইকে জিজ্ঞেস করিস তো?
তুই নিজেই জিজ্ঞেস করিস।
করব। আমি করব। ইন কেস আমি যদি না থাকি, যদি ফুটটুস হয়ে যাই তাহলে তুই জিজ্ঞেস করবি এবং বলবি, লম্বা লম্বা বাত নেহি ছারেগা। ইয়ে গম নেহি।
বুলু নেতিয়ে পড়ল। সোবাহান বলল, তুই এত ঘাবড়াচ্ছিস কেন?
ঘাবড়ালাম কোথায়?
একজন অল্পবয়স্ক ইন্টার্নি ডাক্তার এসে গম্ভীর গলায় বলল, এখানে আপনি কী করছেন? এটা কি ভিজিট করার সময়? এখন যান, চারটার সময় আসবেন।
সোবাহান উঠে দাঁড়াল। সম্ভবত এ ডাক্তারটির কথা কেউ শোনে না। সে হয়তো ভেবেছিল সোবাহান উঠতে চাইবে না। তাকে বিনা তর্কে উঠে দাঁড়াতে দেখে তার হয়তো অস্বস্তি লাগল। সে নরম স্বরে বলল, রোগী আপনার কে?
আমার বন্ধু।
ঠিক আছে চার-পাঁচ মিনিট কথা বলে চলে যান। রোগীকে এখন বিরক্ত করা ঠিক। রেস্ট দরকার।
ওর এ অবস্থা হলো কেন?
খারাপ ধরনের জন্ডিস। লিভার ড্যামেজড হয়েছে। শরীরের সবচেয়ে বড় অর্গানটাই হচ্ছে লিভার। পাঁচ সের ওজন। সেটা ড্যামেজড হলে কী অবস্থা হয় বুঝতেই পারেন।
ডাক্তারটি কোনার দিকের বেডের দিকে চলে গেল। অল্পবয়েসী মেয়ে দুটি মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসছে।
বুলু।
উ।
কেমন লাগছে?
ভালো না।
বেশি খারাপ লাগছে?
হুঁ। তুই এখন যা।
কথা বলার দরকার নাই। তুই শুয়ে থাক চুপচাপ। আমি থাকি আরও কিছুক্ষণ।
শুধু শুধু বসে থেকে কী করবি?
যাবই বা কোথায়?
বুলু চোখ বন্ধ করে পাশ ফিরল। একটি নার্স এসে দুধ পাউরুটি দিয়ে গেল। বুলু ক্লান্তস্বরে বলল–সোবাহান, তুই যা। তোকে দেখে বিরক্ত লাগছে। বিকেলে আসিস। আমি ঘুমাব।
তোকে ঘুমাতে নিষেধ করছি?
যেতে বলছি যা। বাজে তর্ক ভালো লাগে না।
সোবাহান উঠে দাঁড়াল। বুলু থেমে থেমে বলল, বিকেলে আসার সময় এক কাজ করিস, তোর বায়োডাটা, টেস্টিমনিয়েল এইসব নিয়ে আসিস। নাম সই করে একটা ফুলস্কেপ সাদা কাগজ আনিস।
কেন?
আনতে বলছি নিয়ে আসবি। এত কথা কিসের?
বুলু চোখ বন্ধ করে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। একটি মাছি ভনভন করে তাকে বড় বিরক্ত করছে। সে চাঁদর দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল।
.
গুলিস্তানের দিকে রিকশা-টিকশা কিছু যাচ্ছে না। একটা মিছিল বেরিয়েছে। কিসের মিছিল কেউ জানে না। জানার তেমন প্রয়োজনও অবশ্যি নেই। মিছিল হচ্ছে মিছিল। যা দেখামাত্র সেখানে সামিল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
সোবাহান নওয়াবপুর রোডের কাছে মিছিলের দেখা পেল। মাঝারি ধরনের মিছিল। প্রচুর লাল নিশান দেখে মনে হয় শ্রমিকদের কোনো ব্যাপার-ট্যাপার হবে। মিছিলের সঙ্গে হাঁটার একটা আলাদা আনন্দ আছে। সবসময় মনে হয় উদ্দেশ্য নিয়ে কোথাও যাওয়া হচ্ছে।
তাছাড়া চোখের সামনে মিছিলের চরিত্র বদলাতে থাকে, তাও দেখতে ভালো লাগে। যত সময় যায় ততই মিছিলের মানুষগুলি রেগে উঠতে থাকে। একটা সময় আসে যখন শুধু আগুনের কথা মনে হয়। চারদিকে আগুন জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। এটাই সবচেয়ে চমৎকার সময়। তখন পাশের মানুষটিকেও মনে হয় কতদিনের বন্ধু।
কিন্তু আজকের মিছিল জমছে না। প্রাণ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না। প্রধান কারণ সম্ভবত মিছিলের সঙ্গে পুলিশ-গাড়ি নেই। লাল রঙের পতাকাগুলি কড়া রোদে হলুদ হলুদ দেখাতে লাগল। এ মিছিলের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সোবাহান মিছিল ফেলে রেখে বাসায় চলে এল।
আজ দুপুরেও খাওয়া হয়নি। এ অভ্যাসটা সত্যি সত্যি করে ফেলতে পারলে মন্দ হয় না। খাওয়াদাওয়ার ঝামেলাটা তাহলে থাকে না।
সোবাহান বালতি হাতে গোসল সারতে গেল। কাছেই একটা টিউবওয়েল আছে। প্রচণ্ড গরমেও বরফের মতো ঠান্ডা পানি আসে সেখানে। ঝি-শ্রেণীর মেয়েরা এই সময়ে দল বেঁধে গোসল করে। দল বেঁধে ঝগড়া করে। দল বেঁধে হাসে। এ সময়টা ওদের। নিজস্ব।