জি হয়েছে।
আগামী বছর জুন-জুলাই মাসে একবার খোঁজ করবেন। আমি খুব চেষ্টা করব কিছু একটা করতে।
জুন-জুলাই মাসে?
হ্যাঁ। এর আগে যদি কিছু হয় আপনাকে জানানো হবে। আপনার দরখাস্তটা ফাইলে তুলে রাখব।
সোবাহান চা শেষ করে শীতল গলায় বলল, এই কথাটি বলতে আপনার এত দিন লাগল কেন?
তার মানে?
প্রথম দিনই তো আপনি আমাকে এটা বলতে পারতেন। পারতেন না?
রহমান সাহেব চশমা খুলে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ভদ্রলোক রেগে যাচ্ছেন। সহজভাবেই কথাটা নিচ্ছেন তা বোঝা গেল না।
সোবাহান যেভাবে বসে ছিল সেভাবেই বসে রইল। রহমান সাহেব বললেন, আপনি এখন যেতে পারেন।
কিছু মনে করবেন না, আমি এই কথাটির জবাব আপনার কাছ থেকে জেনে তারপর যাব বলে ঠিক করেছি।
কী জানতে চান?
হবে না এই কথাটি বলতে আপনার এত সময় লাগল কেন?
আপনি একজন উদ্ধত প্রকৃতির যুবক। এ ধরনের কাউকে এ ফার্মে আমি কাজ দেব না।
আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দেননি।
রহমান সাহেব উঁচুগলায় বললেন, নাউ ইয়ংম্যান, প্লিজ গেট আউট।
আমি তো আপনাকে বলেছি আমার প্রশ্নের জবাব আপনাকে দিতে হবে।
রহমান সাহেব জ কুঁচকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে রইলেন। কেউ এরকমভাবে তার সঙ্গে কথা বলতে পারে এটা তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। সোবাহান ঠান্ডা স্বরে বলল, আমি কিন্তু আপনার কাছ থেকে জবাব জেনে তারপর যাব। তার আগে যাব না।
বসে থাকবেন?
হ্যাঁ।
সারা দিন বসে থাকবেন?
হ্যাঁ। বসে থেকে আমার অভ্যাস আছে।
রহমান সাহেব প্রথমবারের মতো হাসলেন। চুরুট ধরালেন। এবং হালকা সুরে বললেন, ঠিক আছে বলছি আপনাকে। কারণ না শুনে যখন যাবেন না তখন তো কারণটা। আপনাকে বলতেই হবে। এক মিনিট বসুন, আমি আসছি। চা খাবেন আরেক কাপ?
না।
বেশ, তাহলে বসে থাকুন। এক্ষুনি আসছি। এক মিনিটের বেশি লাগবে না।
রহমান সাহেব ফিরে এলেন না। দু’জন দারোয়ান এসে সোবাহানের ঘাড় চেপে ধরল। ওদের গায়ে তেমন জোর নেই, তবু ওরা সোবাহানকে প্রায় শূন্যে ভাসিয়ে নামিয়ে নিয়ে এল। একজন পেছন থেকে ডান হাত মুচড়ে ধরে আছে। অন্যজন বাঁ হাত এবং চুলের মুঠি ধরে আছে।
রিসিপশনের মেয়েটি তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে। তার চোখ পড়ল সোবাহানের চোখে। সোবাহান চোখ ফিরিয়ে নিল না, তাকিয়েই থাকল। মেয়েটি যেন বড় বেশি অবাক হয়েছে। এত অবাক হওয়ার কী আছে?
.
জলিল সাহেব রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সোবাহানকে দেখে উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলেন? কী হয়েছে আপনার?
কিছু হয় নাই।
রাত দেড়টা বাজে খেয়াল আছে? এরকম লাগছে কেন আপনাকে? কী হয়েছে?
কিছু হয় নাই।
মনসুর সাহেবের বাসায় খাওয়ার দাওয়াত ছিল মনে নাই আপনার? আমরা চিন্তায় অস্থির। আপনার খাওয়া ঘরে এনে ঢাকা দিয়ে রেখেছি। এই যে ভাই, এত মন খারাপ লাগছে কেন? কোথায় ছিলেন?
জলিল সাহেব সোবাহানের হাত ধরলেন।
কী যে কাণ্ড করেন। আমি ভাবলাম একসিডেন্ট টেকসিডেন্ট হলো কি না!
সোবাহান কিছুই বলল না। জলিল সাহেব নিজের মনেই কথা বলে যেতে লাগলেন–যূথি মেয়েটা অনেক রান্নাবান্না করেছিল। আপনি না আসায় মেয়েটার মনটা ছোট হয়ে গেছে। ওর সঙ্গে যে আপনার বিয়ে হচ্ছে তা তো ভাই জানতাম না। মনসুর সাহেবের কাছে আজ শুনলাম। বড় শান্ত মেয়ে। সুখ পাবেন। সুখটাই আসল। আপনার
কী হয়েছে বলেন দেখি?
কিছু হয় নাই।
সার্টটা ছেঁড়া কেন?
জানি না কেন।
আপনার বন্ধু বুলু, তার মামা এসেছিলেন বিকেলবেলা। ওর নাকি অসুখ, মিটফোর্ডে ভর্তি হয়েছে। আপনাকে যেতে বললেন। ভদ্রলোক অনেকক্ষণ আপনার জন্যে বসে ছিলেন।
অসুখ কি খুব বেশি?
হ্যাঁ। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে যাবেন।
হাসপাতালে কবে ভর্তি করিয়েছে?
পরশু দিন।
ঘরে ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যে মনসুর সাহেব উঠে এলেন। যূথি এল পিছু পিছু। খাবারদাবার নিয়ে গেল, গরম করে আনবে। সোবাহান বড় লজ্জায় পড়ল। মেয়েটি মনে হলো তাকে লক্ষ করছে কৌতূহলী চোখে। মনসুর সাহেব বললেন, কোথায় ছিলেন এত রাত পর্যন্ত?
সোবাহান চুপ করে রইল।
হাত-মুখ ধুয়ে আমার ঘরে চলেন। ওখানেই খাবেন। আবার এখানে টানাটানি করা ঝামেলা।
ভেতরের বারান্দায় টেবিলে খেতে দেওয়া হয়েছে। মেয়েটি মাথা নিচু করে এটা। ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। সোবাহান ইতস্তত করে বলল, তুমি খেয়েছ?
যুঁথি মাথা নাড়ল। সে খায়নি।
বসো। তুমিও খাও।
আপনি খান। আমি পরে খাব।
বড় লজ্জা লাগছে সোবাহানের। মেয়েটি তাকে দেখছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। বারান্দায় আর কেউ নেই। মনসুর সাহেব বোধহয় ইচ্ছা করেই আসেননি। সোবাহান নিচুগলায় বলল, তোমার আপা কোথায়?
আপা ঘুমাচ্ছে। উনার শরীর খারাপ। আপনি তো কিছুই খেলেন না।
আমার ক্ষিধে নেই।
হাত-মুখ ধোয়ার সময় মেয়েটি হঠাৎ বলল, আপনি রোজ রাতে এত দেরি করে ফিরেন কেন?
সোবাহান অবাক হয়ে তাকাল। থেমে থেমে বলল, চাকরির ধান্ধায় থাকি। নানান জায়গায় যাই।
পান খাবেন? পান দেব?
না, আমি পান খাই না।
সোবাহান হাত-মুখ ধুয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। যাওয়ার আগে কিছু বলা দরকার। রান্না চমৎকার হয়েছে এই জাতীয় কিছু। তেমন কোনো কথাই মনে আসছে না। মেয়েটি তাকিয়ে আছে তার দিকে। কিছু শোনার জন্যে অপেক্ষা করছে কি? সোবাহান আচমকা বলে ফেলল, মাঝে মাঝে অনেক রাতে তোমাদের এখানে কে কাঁদে?