অল্প কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো মামি। চাকরি শুরু করলেই তোমাকে নিয়ে যাব আমার বাসায়। মামাকে টিট করে দেব। থাক ব্যাটা একা একা বাসায়।
ছিঃ, এইসব কী ধরনের কথা! হাজার হলেও তো মামা।
তাও ঠিক। মামা। মায়ের ভাই। মাদারস ব্রাদার।
তোর ধারণাও ঠিক না–তোকে একেবারে যে অপছন্দ করে তাও না। পছন্দও করে।
বলো কী?
গত রাতে একবার জিজ্ঞেস করল, তুই ভাত খেয়েছিস কি না।
বলো কী? এত বড় সৌভাগ্য আমার! শুনে বড় আনন্দ হচ্ছে মামী। এখন তুমি আমাকে তাড়াতাড়ি বাথরুমে নাও। বিছানা নষ্ট করে দেব।
হুদা সাহেব দুপুরবেলাতে ফিরে এলেন। বুলু পড়ে আছে মরার মতো। ডাকলে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। হুদা সাহেব দুপুরে কিছুই খেলেন না। ছুটাছুটি শুরু করে দিলেন। মিউনিসিপ্যালিটির সামান্য জুনিয়ার ক্লার্ক হয়েও সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় বেলা চারটার সময় তিনি মিটফোর্ড হাসপাতালে একটি সিট জোগাড় করে ফেললেন। হাসপাতালের রেসিডেন্ট ফিজিসিয়ান রোগী দেখে চমকে উঠে বললেন, এত খারাপ অবস্থা! রোগী তো যে-কোনো সময় চলে যাবে। আগে আপনারা করেছেন কী?
হুদা সাহেব হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। এটি হাসপাতালের একটি পরিচিত দৃশ্য। রেসিডেন্ট ফিজিসিয়ানের কোনো ভাবান্তর হলো না। তিনি একটি সিগারেট ধরিয়ে শান্তস্বরে বললেন, বাইরে চলে যান। কান্নাকাটি যা করার বাইরে গিয়ে করবেন। এখানে সিন ক্রিয়েট করবেন না। এতে কাজের ক্ষতি হয়।
.
১৫.
রিসিপশনিস্ট মেয়েটিকে আজ অপূর্ব লাগছে। সবুজ রঙের শাড়িতে কাউকে এত মানায় নাকি?
সোবাহান সাহেব, আপনি কেমন আছেন?
ভালোই আছি।
বসুন, আজ স্যারের সঙ্গে দেখা হবে।
কেমন করে বুঝলেন?
রিসিপশনিস্ট মেয়েটি মিষ্টি করে হাসল।
আমি স্যারকে আপনার কথা বলে রেখেছি।
কী বলেছেন?
বলেছি একজন ভদ্রলোক অনেকদিন ধরে আপনার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করছেন। স্যার বললেন–এগারোটার সময় তাঁর কাছে আপনাকে পাঠাতে।
থ্যাংক ইউ।
সোবাহান সাহেব, আপনি বসুন।
সোবাহান বসল না, মেয়েটির ডেস্কের কাছেই দাঁড়িয়ে রইল।
মনে হচ্ছে আপনার কিছু একটা হবে।
এরকম মনে হচ্ছে কেন?
স্যার নাম বলতেই আপনাকে চিনতে পারলেন। আপনি যে অ্যাপ্লিকেশন করেছেন সেটি আনতে বললেন। চা খাবেন?
না।
না কেন, খান। আপনি বসুন, আমি চা পাঠাবার ব্যবস্থা করছি। গেস্টদের চা দেওয়ার আমাদের যে নিয়ম ছিল সেটি এখন আর নেই। চা আনতে হবে ক্যানটিন থেকে।
ঝামেলা করার দরকার নেই।
ঝামেলা কিছু না।
সোবাহান বসে রইল চুপচাপ। আজই কি সেই বিশেষ দিন? বিশ্বাস হতে চায় না। কোনো কিছুতেই এখন আর বিশ্বাস আসে না। চার বছর কাটল চাকরি ছাড়া। চার বছর খুব লম্বা সময়। এর মধ্যে এক বছর কেটেছে প্রাইভেট টুশনি করে। সেই ছেলে মেট্রিক পরীক্ষায় তিন সাবজেক্ট ফেল করায় টুশনি গেল।
বুলু কোত্থেকে প্রুফ রিডিংয়ের চাকরি জোগাড় করে আনল। তার খুব উৎসাহ। বিনা পরিশ্রমে ঘরে বসে রোজগার। মূলধন হচ্ছে–একটা লাল শিস কলম। গভীর রাত পর্যন্ত দু’জনে মিলে প্রুফ দেখাদেখি। সে কাজও বাদ দিতে হলো। পয়সা যা পাওয়া যায়। তাতে পোয় না।
এরমধ্যে করিম প্রাইজবন্ডের ব্যবসার এক খবর নিয়ে এল। পুরনো প্রাইজবন্ড কিনে মিলিয়ে দেখা প্রাইজ আছে কি না। অনেকেই না দেখে প্রাইজবন্ড বিক্রি করে দেয়। একটা পঞ্চাশ হাজার লাগাতে পারলেই ব্যবসার ক্যাপিটাল চলে আসবে হাতে। করিমের। খাতায় গত দশ বছরের প্রাইজ পাওয়া বন্ডের নাম্বার লেখা আছে। কাজ হচ্ছে বন্ড কেনা। নাম্বার মিলিয়ে দেখা প্রাইজ আছে কি না। না থাকল বিক্রি করে দেওয়া।
করিম চোখের সামনে পাঁচ হাজার টাকার একটা প্রাইজ বাধিয়ে ফেলল। কী তুমুল উত্তেজনা। তারা তিনজন মিলে মানিকগঞ্জ, টঙ্গি, জয়দেবপুর হেন জায়গা নেই যে। যায়নি। বুলু এবং সোবাহান বেশিদিন টিকে থাকতে পারল না। করিম ঝুলেই রইল।
অনেকদিন দেখা হয় না করিমের সাথে। চিটাগাং-এ কোন এক ফার্মে নাকি একটা চাকরি হয়েছে। এখনো প্রাইজবন্ডের সন্ধানে ঘোরে কি না কে জানে।
বড় কষ্ট গিয়েছে জীবনের ওপর। বড়ই কষ্ট। কাজ ছাড়া মানুষ থাকতে পারে? সবচেয়ে অস্বস্তি লাগে ছুটির দিনে। সবার ছুটি, তাদের ছুটি নেই। ছুটি আসে কাজের সঙ্গে। কাজ নেই ছুটিও নেই।
সোবাহান সাহেব।
জি।
যান, স্যারের কাছে যান। এগারোটা বাজে।
এস. রহমান সাহেব হাসিমুখে বললেন, বসুন বসুন। শুনলাম আপনি বেশ কয়েকবার এসেছেন–দেখা হয়নি আমার সঙ্গে।
জি স্যার।
দারুণ ব্যস্ততার মধ্যে থাকি। নানান ঝামেলা। আমি খুবই লজ্জিত–আপনার এতটা ট্রাল হলো।
কোনো ট্রাবল না স্যার। এমনিতে তো ঘরেই বসে থাকতাম।
চা খাবেন?
জি-না। এক কাপ খেয়েছি।
খান, আরেক কাপ খান। আমার সঙ্গে খান।
রহমান সাহেব বেল টিপলেন। চায়ের কথা বললেন। একটা চুরুট ধরালেন। ধরিয়ে আবার নিভিয়েও ফেললেন।
সোবাহান সাহেব।
জি স্যার।
ঠিক এই মুহূর্তে আপনাকে আমরা এবজর্ভ করতে পারছি না।
সোবাহান তাকিয়ে রইল।
ফার্মের অবস্থা ভালো নয়। গত বছর আমরা তিন লক্ষ টাকা লস দিয়েছি। ইউনিয়নের চাপে পড়ে বিশ পারসেন্ট হাউসরেন্ট দিতে হয়েছে। ওরা বুঝতে পারছে না ফার্মের কী ক্ষতিটা ওরা করছে। ফার্মের উন্নতি মানেই ওদের উন্নতি, এই সহজ সত্য ওরা বোঝে না। শুধু আদায় আর আদায়। ফার্মই যদি না থাকে আদায় করবে কী? নিন চা খান। চিনি হয়েছে?