মৃত্যুর পর চোখ বেঁচে থাকার মধ্যে চমকারের কী আছে? যদি কিছু থেকেও থাকে তবে তা অনুভব করার মানুষটি কোথায়? সোবহান চিঠিটি ড্রয়ারে ভরে রাখল। ঠিকানা জোগাড় করে চিঠি দিয়েছে সেই কারণেই দুটি চোখ দিয়ে দেওয়া দরকার। মৃত্যুর পর চোখ বেঁচে থাকবে সে-জন্যে নয়।
দেশ থেকে এসেছে দু’টি চিঠি। একটি ভাবির, অন্যটি ফরিদ আলির। এ চিঠি দুটি রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে আরাম করে পড়তে হবে।
চতুর্থ চিঠিটির হাতের লেখা অপরিচিত। কে হতে পারে? পুরনো বন্ধুদের কেউ? তারাপদ নয় তো? আইএসসি পাশ করে কীভাবে চলে গেল জার্মানি, তারপর আর। খোঁজখবর নেই। হয়তো দেশে ফিরে ঠিকানা বের করে লিখেছে। তারাপদের কথা খুব মনে হয়।
চিঠি তারাপদের নয়। চিঠিটি মিলির লেখা। বিরাট এক কাগজে চার-পাঁচ লাইনের ছোট্ট চিঠি।
সোবাহান ভাই,
আম্মা চাকরির জন্যে যে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলেন আপনি কি তার সঙ্গে দেখা করেছেন? আম্মা তা জানতে চান। এখনো দেখা না করে থাকলে খুব অন্যায় করেছেন। দেখা করবেন, ফলাফল জানাবেন।
মিলি
সোবাহান হাতমুখ ধুয়ে অবেলায় হোটেলে খেতে গেল। এখন ভাত খাওয়ার কোনো অর্থ। হয় না। গরম গরম সিঙ্গারা ভাজা হচ্ছে। দুটি সিঙ্গারা এক কাপ চা খেয়ে বাসায় ফিরে দেখে, মনসুর সাহেব বারান্দায় ইজিচেয়ার পেতে শুয়ে আছেন।
স্নামালিকুম। আপনার কি শরীর খারাপ?
না ভাই, শরীর ঠিকই আছে। আপনারা আছেন কেমন?
ভালোই আছি।
ফ্যান কিনেছেন দেখলাম। ভালোই করেছেন। যা গরম। বাইরে একটা চেয়ার এনে বসেন না গল্প করি।
সোবাহান চেয়ার এনে বসল। মনসুর সাহেব হাসিমুখে বললেন, আজই আপনার ভাইয়ের একটি চিঠি পেয়েছি। বিয়ের ব্যাপার আষাঢ় মাসের মধ্যে সেরে ফেলতে চান। আমাদের আপত্তি আছে কি না জানতে চেয়েছেন।
সোবাহান কিছুই বলল না।
আমাদের তরফ থেকে কোনোই আপত্তি নাই। শুভ কাজ। যত তাড়াতাড়ি হয় ততই ভালো। আপনাকে জানিয়ে দিলাম। আপনার ভাইকেও আজকালের মধ্যে চিঠি লিখব।
ভদ্রলোক পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেট বের করলেন।
নেন, সিগারেট নেন। যূথিকে চা দিতে বলেছিলাম। আপনার জন্যেও দিতে বলি। আর ভাই শোনেন, ওকে নিয়ে যদি বাইরে টাইরে যেতে চান–চিড়িয়াখানা পার্ক এসব। আর কী, তাহলে যাবেন। অসুবিধা কিছু নাই। বিয়ের আগে চেনা থাকা দরকার। বৃথি! যূথি!
যূথি বের হয় এল। সোবাহানকে দেখে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে পড়ল।
দাও, তোমার সোবাহান ভাইকে চা দাও।
মেয়েটির মাথা আরও নিচু হয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল উল্টোদিকে। মনসুর সাহেব বললেন, আপনি আর জলিল সাহেব পরশু রাতে আমার এখানে চারটা ডালভাত খাবেন।
সোবাহান নিচুস্বরে বলল, তার কোনো দরকার নেই।
আছে দরকার আছে। রোজ রোজ হোটেলে খান। মাঝে মধ্যে ঘরের খাওয়াদাওয়া দরকার। যূথি, তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? চা দিতে বললাম না? নাকি কানে আজকাল শুনতে পাও না।
যুঁথি দ্রুত ঘরের ভেতরে ঢুকতে গিয়ে কপালের সঙ্গে ধাক্কা খেল। মনসুর সাহেব অস্ফুট স্বরে বললেন, সংয়ের মতো চলাফেরা, অসহ্য!
মনসুর সাহেবের মন ভালো নেই। তাঁর স্ত্রী আজ অন্যদিনের চেয়েও বেশি বিরক্ত করছে।
.
১৪.
বুলু চিঁচি করে বলল, আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেন।
বুলুর মামা হুদা সাহেব বললেন, হাসপাতাল কেন?
আমার অবস্থা সুবিধার না।
তুই বুঝলি কী করে?
বোঝা যায়, অবস্থা খারাপ হলে ডাক্তারের আগে টের পায় রোগী।
হুদা সাহেব তাকিয়ে রইলেন বুলুর দিকে। গতকাল থেকে বুলু ফটফট করে কথা বলছে। আগে তার ছায়া দেখলে বুলুর দম বন্ধ হয়ে আসত। হ্যাঁ কিংবা না বলতেই তিনবার বিষম খেত। এখন দিব্যি কথাবার্তা বলছে। কথা বলবার ভঙ্গি এরকম যেন ইয়ার দোস্তের সঙ্গে আলাপ করছে। হুদা সাহেব বহু কষ্টে রাগ সামলালেন। কঠিন স্বরে বললেন, চুপচাপ শুয়ে থাক।
শুয়েই তো আছি। বসে আছি নাকি?
ফটফট করছিস কেন?
ফটফট করছি না। হাসপাতালে ভর্তি করতে বলছি। যত তাড়াতাড়ি সেটা করা যায় ততই ভালো। দি আরলিয়ার দি বেটার।
বুলুর গালে একটা চড় বসাবার প্রচণ্ড ইচ্ছা বহু কষ্টে সামলে হুদা সাহেব পাশের। ঘরে গেলেন। নটা বেজে গেছে, অফিস যেতে হবে। পাগলামি শুনবার সময় নেই। বুলু ডাকল, মামা! ও মামা!
কী?
চিন্তা করে দেখলাম আপনার পক্ষে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব না। চেহারা পালোয়ানের মতো হলেও হাসপাতালের লোকজন বডিবিল্ডারদের পাত্তা দেয় না। আপনি বরং আমার বন্ধুদের কাউকে খবর দেন।
হুদা সাহেব এই প্রথমবার শান্তস্বরে কথা বললেন। অবিশ্বাস্য রকমের নরম সুরে বললেন, অফিস থেকে এসে দেখব কী ব্যাপার। জয়নাল ডাক্তারকে বলে যাব, দুপুরে একবার যেন দেখে যায়।
হুদা সাহেব অফিস গেলেন চিন্তিত মুখে।
বুলু আর কোনো সাড়াশব্দ করল না। বুলুর মামি দুপুরে এক বাটি চিড়ার পানি এনে খাওয়াতে চেষ্টা করলেন। কয়েক ঢোক গিলেই বুলু বমি করল।
মামি, তোমার শাড়ি বোধহয় নষ্ট করে দিলাম।
মামি কিছু বললেন না। তাকে খুব চিন্তিত মনে হলো। এই ছেলেটির প্রতি তার খুব মমতা।
মামি, বাথরুমে যাওয়া দরকার। ধরতে পারবে?
পারব।
তোমার যে স্বাস্থ্য, নিজেকেই সামলাতে পার না।
শরীরটা বেশি খারাপ বুলু?
হুঁ।
তোর মামার সঙ্গে এইভাবে কথা বলিস নারে বাবা। লোকটা রাগলে মুশকিল। আমারও মুশকিল।