ডিফারেন্সটা সম্পর্কে একটা রসালো জিনিস জলিল সাহেব আধা ঘণ্টা ধরে বলার পর বাতি নিভিয়ে ঘুমোতে গেলেন। বাতি নেভাবার সঙ্গে সঙ্গে একটা মশা সোবাহানের কানের কাছে পিন পিন করতে লাগল। মশার আত্মা নাকি? সেই মৃত মশাটিই কি ফিরে এসেছে? জগতে অনেক অমীমাংসিত রহস্য আছে। ঘুম এল না। মশাটি বিরক্ত করতে লাগল। একবার উঠে বাতি জ্বালাল। মশারির ভেতর কিছুই নেই। কিন্তু ঘুমোতে গেলেই তাকে পাওয়া যাচ্ছে–পি পি পিন পিন। পিঁ পিঁ পিন পিন।
ঘুম আসছে না, ঘুম আসছে না। অসহ্য গুমট। হাওয়া নেই, এক ফোঁটা হাওয়া নেই। সোবাহান একসময় দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল। কোথাও হাওয়া নেই। আকাশে মেঘ আছে কি? সে তাকাল আকাশের দিকে। মেঘশূন্য আকাশ। ভালো লাগে না। কিছু ভালো লাগে না। ভেতরের বাড়ি থেকে কান্নার শব্দ আসছে। কে কাঁদছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মনসুর সাহেবের স্ত্রী? না তার ছোট শালী? এ বাড়িতে মাঝে মাঝে এরকম অস্বস্তিকর কান্না শোনা যায়। কে কাঁদে কে জানে?
সোবাহান! সোবাহান সাহেব!
জি।
একটু আসেন ভিতরে।
কী হয়েছে?
আরে ভাই আসেন না। বিনা কারণে কেউ ডাকে না।
সোবাহান ঘরে ঢুকে দেখল, জলিল সাহেব বমি করে তার বিছানার একাংশ ভাসিয়ে চোখ বড় বড় করে বসে আছেন। ঘরময় কটু ঝাঁঝালো গন্ধ। বাতাস ভারী হয়ে আছে।
কী হয়েছে?
কিছু না।
আপনার কি শরীর খারাপ নাকি?
না।
বমি করে তো ঘর ভাসিয়ে ফেলেছেন।
সন্ধ্যার পর এক ঢোক খেয়েছিলাম। সস্তার জিনিস। সস্তার তিন অবস্থা। প্রথম অবস্থায় নেশা। দ্বিতীয় অবস্থায় বমি। তৃতীয় অবস্থায় আবার বমি।
বলতে বলতেই মুখ ভর্তি করে আবার বমি করলেন। তার হিক্কা উঠতে লাগল। সোবাহান কী করবে বুঝে উঠতে পারল না।
সোবাহান সাহেব।
জি।
পানি আনেন। হা করে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। ভয় নাই, আমি নিজেই পরিষ্কার করব। নিজের গা নিজেই পরিষ্কার করতে হয়। এটা কপালের লিখন। একটা ঝাটা জোগাড় করেন।
সব পরিষ্কার টরিষ্কার করে তারা যখন ঘুমোতে গেল তখন কেঁপে বৃষ্টি নামল। জলিল উফুল্ল স্বরে বললেন, বৃষ্টি নামল–দেখলেন তো?
জি দেখলাম।
বলেছিলাম না বৃষ্টি হবে?
হুঁ বলেছিলেন।
জলিল সাহেব গলা টেনে হাসতে লাগলেন।
সোবাহান সাহেব!
জি।
ঠিক আছে ঘুমান। আমি একটু বসি বারান্দায়।
জলিল সাহেব মশারি থেকে বের হয়ে এলেন। ভেতরবাড়ি থেকে কান্না শোনা যাচ্ছে। সোবাহান মৃদুস্বরে বলল, কে কাঁদে জানেন?
জলিল সাহেব উত্তর দিলেন না। সোবাহান বলল, প্রায়ই শুনি।
জলিল সাহেব ঠান্ডাস্বরে বললেন, যার ইচ্ছা সে কাঁদুক, কিছু যায় আসে না। আমাদের একটা ঘর সাবলেট দিয়েছে আমরা আছি। মাসের শেষে দেড়শ টাকা ফেলে দেই, ব্যস। যার ইচ্ছা কাঁদুক, কী যায় আসে বলেন? কিছুই আসে যায় না।
.
জলিল সাহেব দরজা খুলে বারান্দায় বসে রইলেন। ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। শীতল হাওয়া দিচ্ছে। কানের কাছে মশা পিন পিন করছে না। কিন্তু ভেতর বাড়িতে কেউ একজন কাঁদছে। প্রায়ই সে কাঁদে। কেন কাঁদে কে জানে। শুনতে ভালো লাগে না। মেয়েদের কান্নায় ঘুমপাড়ানি কিছু আছে। সোবাহানের ঘুম পেতে থাকে। ঘুম আসার সময়টা বেশ সুন্দর। গভীর কোনো নির্জন দিঘিতে ডুবে যাওয়ার সঙ্গে এর একটা মিল আছে। মিলটি সোবাহান ধরতে পারে, কারণ সে একবার সত্যি সত্যি ডুবে যেতে বসেছিল। শুরুটাই ভয়ের। তারপর কোনো ভয় নেই–আলো কমে যেতে শুরু করে, শব্দ কমে যেতে শুরু করে।
ব্রাদার, ঘুমিয়ে পড়লেন? এই সোবাহান সাহেব!
না, ঘুমাইনি। কেন?
বমি করার পর পেটে আর কিছু নাই। ক্ষিদে লেগে গেছে।
আমাকে বলে কী লাভ?
তা ঠিক। ঘুমান। আমি বরং এক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়ি, কী বলেন?
খান। ইচ্ছে হলে খান।
খালিপেটে পানি খেলে আবার বমি হবে না তো?
সোবাহান জবাব দিল না। এই লোকটির সঙ্গে আর থাকা যাচ্ছে না। আগের মেসটিতেই ফিরে যেতে হবে। অসহ্য! সোবাহান ঠিক করল কাল ভোরে প্রথম যে কাজটি করবে সেটা হচ্ছে–কুমিল্লা বোর্ডিং-এ ফিরে যাবে।
কিন্তু সে নিশ্চিত জানে এটা করা হবে না। কারণ সকালে তাকে যেতে হবে চাকরির ব্যাপারে। তারপর আর উৎসাহ থাকবে না। তাছাড়া কারও সঙ্গে বেশি দিন থাকলেই একটা মায়া জন্মে যায়। ছেড়ে যেতে কষ্ট হয়। জলিল সাহেবের সঙ্গে সোবাহান আছে প্রায় পাঁচ বছর ধরে। প্রথম দু’বছর বেঙ্গল মেস হাউসে। বাকি তিন বছর কুমিল্লা বোর্ডিং এ। এবং এখন শ্যামলীর এই বাড়িতে। জলিল সাহেবের ব্যবস্থা। সোবাহান আসতে। চায়নি। জলিল সাহেব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ভুলিয়েছেন।
মেসে সারা জীবন পড়ে থাকবেন নাকি! একটা ফ্যামিলির সঙ্গে এ্যাটাচড থাকা ভালো। ঘরের রান্না খাবেন। তার টেস্টই অন্যরকম। অসময়ে এক কাপ চা খেতে চাইলেন, জাস্ট গিয়ে বলবেন–ভাবি, এক কাপ চা। ওমনি চা এসে যাবে। সঙ্গে একটা বিসকিট কিংবা এক প্লেট মুড়ি ভাজা।
জলিল সাহেবের মিষ্টি কথার কোনোটি সত্যি হয়নি। তিনি অবশ্যি অনেক চেষ্টা করেছিলেন পেইংগেস্ট হতে। কিন্তু বাড়িওয়ালা মনসুর সাহেবের স্ত্রী খুব পর্দানশীন। এই যে দু’টি লোক বাড়ি সাবলেট নিয়ে আছে, তাদের সঙ্গে এখনো এই মহিলাটির কোনো কথা হয়নি। একবার শুধু এক বড় জামবাটি ভর্তি পায়েস পাঠিয়েছিলেন। সেই পায়েস খেয়ে জলিল সাহেবের পেট নেমে গেল। তিনি গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলেন–পায়েসটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ফেলে দেওয়ার বদলে আমাদের ধরিয়ে দিয়েছে। মহা হারামি! এখানে থাকা যাবে না রে ভাই। কুমিল্লা বোর্ডিংই ভালো। সেখানে ফিরতে হবে। কপালের লিখন।