সোবাহান গলা উঁচিয়ে ডাকল, কত রাত পর্যন্ত বসে থাকবেন? আসেন শুয়ে পড়ি।
জলিল সাহেব কোনো জবাব দিলেন না। কতক্ষণ এভাবে বসে কাটাবেন কে জানে।
.
১৩.
রহমান সাহেব আজও অফিসে আসেননি।
সোবাহান চরম ধৈর্যের পরিচয় দিল। লাঞ্চ আওয়ার পর্যন্ত বসে রইল একভাবে। ডান পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেল। তবু নড়ল না। বাথরুমে যাওয়া দরকার তাও গেল না। একভাবে বসে থেকে নিজেকে কষ্ট দেওয়া। এর পেছনে উদ্দেশ্য আছে। সোবাহান। দেখেছে খুব কষ্টের পর একটা কিছু ভালো ঘটে যায়। আজও হয়তো এরকম হবে। হঠাৎ দেখা যাবে লাঞ্চের পর এস. রহমান সাহেব এসে পড়েছেন। সোবাহানকে দেখে বললেন–ও আপনি! আসুন, উপরে চলে আসুন। কাজের ঝামেলায় ব্যস্ত ছিলাম দেখা হয়নি। তার জন্যে অত্যন্ত লজ্জিত। আজ যত কাজই থাকুক আপনারটা আগে শেষ করব। কিছু খাবেন? ঠান্ডা কিছু?
বাস্তবে সেরকম কিছু ঘটল না। লাঞ্চ আওয়ারে সবাই খেতে টেতে গেল। আবার ঘণ্টাখানিক পর ফিরে এল। রহমান সাহেবের দেখা নাই। রিসিপশনিস্ট মেয়েটি আজ তাকে দেখেও দেখছে না। নাকি ভুলে গেছে? কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়—আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন? আমি শ্যামলীতে থাকি, সোবাহান। রহমান সাহেবের পি.এর সঙ্গে একবার কথা কাটাকাটি হয়েছিল? মনে আছে আমাকে?
মনে থাকার ব্যাপারটি বিচিত্র। কাউকে কাউকে একবার দেখলেই সারা জীবন মনে থাকে। আবার এমন লোকও আছে যাদের সঙ্গে বারবার দেখা হয় তবু তাদের কথা মনে থাকে না। প্রতিবারই তাদের সঙ্গে নতুন করে পরিচয় করতে হয়। যেমন বুলু। বুলু বলে, দেশের বাড়িতে পাঁচ-সাত দিন থেকে ঢাকায় এলে তার মামা নাকি তাকে চিনতে পারেন না। বুলুকে মাথা নিচু করে বলতে হয়–আমি বুলবুল। বুলুর ধারণা সব মানুষের চেহারার সঙ্গে কারও-না-কারও মিল থাকে। পরিচিত কাউকে সে মনে করিয়ে দেয়। এ জন্যেই কোনো মানুষকেই কখনো পুরোপুরি অচেনা লাগে না। বুলুকে লাগে। সে নাকি কাউকে মনে করিয়ে দেয় না।
সোবাহান সাহেব!
সোবাহান চমকে তাকাল। রিসিপশনিস্ট মেয়েটি তাকে ডাকছে। নাম তাহলে মনে। আছে। সোবাহান এগিয়ে গেল। পায়ে ঝিঁঝি ধরেছে। হাঁটতে হচ্ছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে। মেয়েটি হাসিমুখে তাই দেখছে।
আমাকে কিছু বলছেন?
হ্যাঁ। রহমান সাহেব টেলিফোন করেছেন তিনি সাড়ে তিনটার দিকে আসবেন। আপনি কি বসবেন এতক্ষণ?
হ্যাঁ বসব।
অফিস ইউনিয়নের সঙ্গে তার একটা মিটিং আছে। মিটিং শেষ হতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে।
লাগুক যতক্ষণ লাগে। আমি বসে থাকব। বাইরে রোদে ঘোরাঘুরি করার চেয়ে এখানে বসে থাকায় আরাম আছে।
মেয়েটি হাসিমুখে বলল, ইউনিয়নের সঙ্গে মিটিংয়ের পর স্যারের মেজাজ খুব খারাপ থাকে। আপনার যাওয়া উচিত যখন তার মেজাজ থাকে ভালো।
মেজাজের ওপর তো চাকরি হবে না। চাকরি হওয়া না-হওয়ায় মেজাজটা কোনো ডিটারমিনিং ফেক্টর নয়।
যেভাবে কথা বলছেন তাতে মনে হয় ডিটারমিনিং ফেক্টরগুলি আপনার পক্ষে।
আমি এখনো জানি না। একজন ভদ্রমহিলা আমাকে একটা চিঠি দিয়ে এখানে পাঠিয়েছেন। ভদ্রমহিলার ধারণা চিঠি দেখানো মাত্র আমার চাকরি হবে।
দেখিয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
কী বললেন চিঠি পড়ে।
পরে দেখা করতে বললেন।
মেয়েটি ইতস্তত করে বলল, কী লেখা ছিল সেই চিঠিতে জানেন?
খামের চিঠি, আমি পড়ে দেখিনি।
আপনার পায়ের ঝিঁঝি এখনো কমে নাই?
জি-না। কমতে অনেক সময় লাগছে।
শেষ প্রশ্নটিতে সোবাহান বেশ অবাক হলো।
আপনি তো সারা দুপুর কিছু খাননি? আমাদের এখানকার স্টাফদের জন্যে ক্যান্টিন আছে। দুপুরে রুটি-গোশত পাওয়া যায়। আপনি ইচ্ছে করলে সেখানে খেতে পারেন। বেশ সস্তা।
আমি তো স্টাফ না।
একদিন হয়তো হবেন। আসেন আমার সঙ্গে, আমি বলে দিচ্ছি। আমিও না হয় আপনার সঙ্গে চা খাব এক কাপ।
সোবাহানের বুক শুকিয়ে গেল। পকেটে টাকা আছে ছ’টি। রুটি-গোশত খেতে কত লাগবে কে জানে। একটি মেয়ের সামনে কখনো বলা যায় না–ভাই, আমার তো দু’টি টাকা কম পড়েছে। কাল এসে দিয়ে যাব। কিছু মনে করবেন না।
না খেয়েই বসে থাকবেন, না যাবেন?
আজ আর অপেক্ষা করব না। বাসায় চলে যাব। কাল পরশু একবার আসব।
সোবাহান মেয়েটিকে দ্বিতীয় কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এল।
বাসে করে শ্যামলী এসে পৌঁছাতে লাগল পঁয়তাল্লিশ মিনিট। ফাঁকা বাস। ফাঁকা বাসে উঠে বসলে আপনাতেই মন ভালো হয়ে যায়। সিগারেট ধরিয়ে মুখ ভর্তি করে ধোয়া ছাড়তে ইচ্ছা করে।
মন ভালো ভাবটি বাসায় পৌঁছেও বজায় রইল। সোবাহান দেখল চারটি চিঠি এসেছে তার নামে। একটি খুলে পড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। খামের আকৃতি ও রঙ দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা একটা রিগ্রেট লেটার। উপরের ঠিকানাটা যেহেতু বাংলায় ভেতরের চিঠিটিও বাংলাতেই লেখা। লেখার ধরনটাও বলে দেওয়া যায়। জনাব, আপনাকে অত্যন্ত দুঃখের সহিত জানাইতেছি যে, বর্তমানে আমাদের সংস্থায় কোনো কর্মখালি নাই। ভবিষ্যতে কোনো শূন্য পদ সৃষ্টি হইলে আপনার সহিত যোগাযোগ করা হইবে। আর এই বিষয়ে কোনো অনুসন্ধান করিবার প্রয়োজন নাই।
ভেতরের লেখা কী হবে জেনেই এই খামটিই সোবাহান আগে খুলল। যা ভাবা গিয়েছে তা নয়। চোখ দান করার জন্যে অনুরোধ করে লেখা। ছাপানো চিঠি। শেষ লাইনে লেখা–মৃত্যুর পরও আপনার চোখ অনেকদিন বেঁচে থাকবে। এর চেয়ে চমকার ব্যাপার আর কী হতে পারে?