অফিস আড্ডা দেওয়ার জায়গা নাকি?
করিম রাগে চিড়বিড় করতে থাকে।
করিমের হতাশ মুখ দেখতে বড় ভালো লাগে সবার। অ্যাশট্রেতে ছাই না ফেলে ওরা ইচ্ছা করে মেঝেতে ছাই ফেলে। হো হো করে হাসে। করিমের অফিসের সুন্দরী স্টেনোটি হেডমিস্ট্রেসের মতো চোখে তাকায়।
ছুটির দিনে এদের কারও কাছেই যাওয়া যায় না। বেকার বন্ধুদের কাছেও যাওয়া যায় না। ওদের সেদিন নানান কাজ থাকে। সপ্তাহের বাজার করতে হয়। এর বাড়ি ওর বাড়ি যেতে হয়। বুলুর কথাই ঠিক–ছুটির দিনে যে সবচেয়ে ব্যস্ত থাকে সে হচ্ছে একজন বেকার।
রোদ মরে আসছে। সোবাহান আকাশের দিকে তাকাল। মেঘ। আকাশ বিবর্ণ হতে শুরু করেছে। জোর বৃষ্টি হবে। সোবাহানের মন হঠাৎ ভালো হয়ে গেল। বুলু এই কথাটিও ঠিক বলে–আকাশে মেঘ দেখলে সবচেয়ে খুশি হয় বেকার যুবকেরা।
সোবাহান একটা পান কিনল। এবং ঝট করেই দেড় টাকা খরচ করে একটা ফাইভ ফাইভ কিনে ফেলল। মাঝে মাঝে বিলাসী হতে ইচ্ছা করে। অকারণে দেড় টাকা ছাই করে ফেলার মধ্যে একধরনের আনন্দ আছে।
বিকাল পাঁচটার দিকে বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির আগে আগে সোবাহান চলে গেল মালিবাগে। রেশমা মালিবাগে থাকে। তবে তাকে পাওয়া যাবে কিনা কে জানে? তাকে কখনো পাওয়া যায় না। সবসময় তার ডিউটি পড়ে অসময়ে। গত বছরই ডিটটি পড়ল ঈদের দিন।
রেশমার বাবা দরজা খুলে দিলেন।
রেশমা আছে?
হ্যাঁ আছে। বসেন।
আমাকে চিনেছেন?
জি। আপনি বুলবুলের বন্ধু। বসেন।
আপনার শরীর কেমন?
ভালো না। বসেন রেশমাকে ডাকি।
ঝড়ের আশঙ্কায় জানালা-টানালা সব বন্ধ। ঘরের ভেতরে গুমোট। হাওয়া ভারী হয়ে আছে। সোবাহান জানালা খুলে দিতেই রঙিন পর্দা পালের মতো উড়তে লাগল। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। টিনের ছাদ। ঝমঝম করে শব্দ হচ্ছে। অপূর্ব।
সোবাহান ভাই, কেমন আছেন?
রেশমা গোসল করে এসেছে। চুলে গামছা জড়ানো। জলের সঙ্গে মেয়েদের কোনো একটা সম্পর্ক হয়তো আছে। গা-ভেজা সব মেয়েকেই জলকন্যার মতো লাগে।
আপনি এখানে এলেন প্রায় দু’মাস পর।
সোবাহান হাসল। মেয়েরা দিন-ক্ষণের হিসাব খুব ভালো রাখে।
আপনার বন্ধু বলছিল আপনি নাকি এক বুড়োর সঙ্গে থাকতে থাকতে বুড়োদের মতো হয়ে গেছেন। কথা টথা কম বলেন।
বুড়োরা কথা কম বলে নাকি? আমার তো ধারণা ওরা কথা বলে সবচেয়ে বেশি।
কথা বেশি বলে রোগীরা। বকবক করে মাথা ধরিয়ে দেয়।
সোবাহানের ভয় হলো রেশমা হয়তো হাসপাতালের গল্প শুরু করবে। নার্সরা। রোগীদের গল্প খুব আগ্রহ নিয়ে বলে। সে গল্পে সবকিছুই থাকে–রোগীর বয়স, তার বাড়ি, তার ছেলেমেয়ে; কিন্তু রোগের কথা থাকে না। রোগের যন্ত্রণার প্রসঙ্গ একবারও আসে না। সোবাহান কথার মোড় ঘোরাবার জন্যে বলল, বুলুর কাছে গিয়েছিলাম।
কেমন আছে আপনার বন্ধু?
বেশি ভালো না, জণ্ডিস হয়েছে।
কী ধরনের জণ্ডিস? ইনফেকটাস হেপাটাইটিস?
তা তো জানি না।
বিলরুবিন টেস্ট করিয়েছে?
জানি না। খুব সম্ভব না।
রেশমা হঠাৎ অন্য প্রসঙ্গে চলে এল। হাসিমুখে বলল, চায়ের সঙ্গে কী খাবেন?
কী আছে?
কিছুই নাই। আনাব। মুড়ি ভেজে দেই?
দাও।
আপনি বসে বসে ঝড়বৃষ্টি দেখেন। আমি চা নিয়ে আসছি। দেরি হবে না।
রেশমা, একটা সিগারেটও আনতে বলবে।
সোবাহান বসে রইল একা একা। বসার ঘরটা ছোট হলেও বেশ গোছানো। সুন্দর। একটা শোকেস আছে। যার নিচের তাকে বেশ কিছু গল্প-উপন্যাসের বই। বইগুলির একটিও মলিন নয়। ঝকঝক করছে। রেশমা বই পড়ে মলাট লাগিয়ে। পড়া হলেই মলাট খুলে শোকেসে তালা লাগিয়ে দেয়। বুলু একবার কী একটা বই নিয়ে তরকারির সরুয়া ভরিয়ে ফেরত দিল। রেশমা রাগে তিনদিন কথা বলল না।
ঘর অন্ধকার হয়ে আসছে। বাতি জ্বালাতে ইচ্ছে করছে না। জ্বালাতে গেলে হয়তো। দেখা যাবে কারেন্ট নেই। সোবাহান নিচু হয়ে বসে বইগুলির নাম পড়তে চেষ্টা করল। গল্পের বই-টই অনেকদিন পড়া হয় না। কী হবে গল্পের বই পড়ে? একজন বানানো মানুষের কথা পড়ে কী লাভ? সেই বানানো মানুষটি প্রেম করে হাসে কাঁদে। কী আসে যায় তাতে? কিছুই আসে যায় না।
সোবাহান ভাই, চা নেন। ঘর অন্ধকার করে বসে আছেন কেন? এই নেন সিগারেট।
কাগজে মোড়া দুটো সিগারেট রেশমা বাড়িয়ে দিল।
একটার কথা বলেছিলাম, দুটো আনলে কেন?
মেয়েরা কোনো জিনিস একটা দেয় না।
চা কিন্তু এক কাপ দিয়েছ।
রেশমা হেসে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, আপনার বন্ধু কি গয়না প্রসঙ্গে কোনো কথা বলেছে?
বলেছে।
আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল কাউকে বলবে না। এখন আমার মনে হয় সবার কাছেই বলে বেড়াচ্ছে। এটা ঠিক না।
প্রতিজ্ঞা করা হয় প্রতিজ্ঞা ভাঙার জন্যেই। এটাই নিয়ম।
রেশমা কিছু বলল না, গম্ভীর হয়ে রইল। সোবাহান বলল, ওর চাকরিটা খুব দরকার। কিছু না হলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে।
আপনার দরকার নাই?
আমারও দরকার। তবে ওর যেমন চাকরি পেলেই বিয়ে করার প্ল্যান আমার তো তেমন কিছু নেই।
রেশমা বলল, ওর অসুখ কি খুব বেশি?
খুব বেশি না। আমার সঙ্গে তো হোটেল পর্যন্ত এল।
আপনার অসুখের কী অবস্থা?
আমার আবার কী অসুখ?
ও বলছিল রাতে নাকি আপনি ঘুমাতে পারেন না। শুধু মনে হয় কানের কাছে মশা পিন পিন করছে।
বুলু বলেছে না?
হ্যাঁ। তাছাড়া আপনার স্বাস্থ্যও অনেক খারাপ হয়েছে। দাড়ি কামান না কেন?