রাগ করার কী আছে? বত্রিশ বছর বয়স হয়েছে এখনো সিগারেট খেতে পারবি না?
আস্তে কথা বল। সিগারেট খেতে হলে বাইরে গিয়ে খেয়ে আয়।
আমি উঠলাম। যেদিন মামা থাকবে না সেদিন আসব।
আরে বস বস। কথা আছে। চায়ের কথা বলে আসি।
সোবাহান চমকাল। এটা নতুন কথা। বুলু কাউকে চা খেতে বলে না। মোড়ের চায়ের দোকানে নিয়ে যায়। বুলু ফিরে এসেই শুয়ে পড়ল। নিস্পৃহ গলায় বলল, চা আসছে। মামিকে বলে এসেছি।
ব্যাপার কী? রাজার হালে আছিস মনে হয়। চাকরি হয়েছে নাকি?
এখনো হয় নাই। হবে। শিগগিরই হবে।
বলিস কী! কোথায়?
পিডিবিতে।
ম্যানেজ করলি কীভাবে?
ঘুষ। সাত হাজার দিয়েছি। দশ হাজার চেয়েছিল।
পেলি কোথায় এত টাকা? মাই গড!
বুলু গম্ভীর হয়ে গেল। চা দিয়ে গেল ওদের কাজের মেয়ে। কাপে কাঁচা মাছের গন্ধ। এক চুমুক খেয়েই সোবাহান কাপ নামিয়ে রাখল। বমি আসছে।
চা খাবি না?
না, মাছের গন্ধ।
বুলু কিছু বলল না। তার মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। চোখের বর্ণ হলুদ। মাথার চুলও মনে হয় পড়ে গেছে। ফাঁকা ফাঁকা লাগছে মাথা।
তোর কি টাক পড়ে যাচ্ছে নাকি?
হুঁ। বাবার টাক ছিল। পৈতৃকসূত্রে পাওয়া। টাকাপয়সা কিছু পাই নাই। এটাই পেয়েছি।
ঘুষের টাকা জোগাড় করলি কীভাবে?
বুলু গলার স্বর দুধাপ নামিয়ে ফেলে বলল, রেশমা দিয়েছে।
বলিস কী?
হুঁ। চার হাজার টাকা সোনার ভরি। তিন গাছি চুড়ি দিয়েছে। একেকটা একেক ভরি। ভরিতে পাঁচ আনা করে খাদ কেটে ন’হাজার টাকা হয়েছে।
বাকি দু’হাজার টাকা কী করলি?
করব আবার কী, আমার কাছেই আছে।
তোর মামা এসব জানে না?
নাহ।
রেশমার কাছে টাকা চাইতে লজ্জা লাগল না?
নাহ্। তুই এখন যা সোবাহান। মাথা ঘুরছে। শুয়ে থাকব খানিকক্ষণ।
সোবাহান তবুও বসে রইল। বুলুর এখানে আসা হয় না। অনেকটা দূর। এসেই চট করে চলে গেলে পোষায় না। একটার দিকে সোবাহান বলল, চায়ের দোকানে যাবি নাকি?
আরে না। আমার উঠার শক্তি নাই। তুই এখন যা। নাকি পয়সার দরকার? লজ্জা করিস না, বল।
না।
দরকার থাকলে বল। ওই দু’হাজার টাকা থেকে দেব। এক মাসের মধ্যে ফেরত দিতে হবে। ওটা আমার বিয়ের টাকা। চাকরি হলেই বিয়ে করব।
চাকরি হবে কবে নাগাদ?
বারো তারিখে ইন্টারভ্যু। সামনের মাসের এক তারিখে জয়েন করতে হবে।
বিয়ে কি সামনের মাসেই হবে?
হুঁ। কি, তোর লাগবে কিছু?
নাহ্।
লজ্জা করিস না।
রেশমা আছে কেমন?
ভালোই আছে।
তোর অসুখের খবর জানে?
নাহ্।
যদি চাস তো খবর দিয়ে আসতে পারি।
কী হবে খবর দিয়ে। খামাখা দুশ্চিন্তা করবে। সোবাহান, আজ তুই বাড়ি যা, কথা বলতে ভালো লাগছে না।
বাড়ি কোথায় যে যাব?
অন্য কোথাও যা। অন্যদের বিরক্ত কর।
ঘরের ভেতর থেকে মামার হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে। ঝনঝন করে কিছু একটা ভাঙল। বাচ্চা একটা মেয়ে কাঁদতে শুরু করল। বুলু মৃদুস্বরে বলল, মামার রাগ উঠে যাচ্ছে। উঠ সোবাহান, আর না। আবার ঝন ঝন করে কিছু একটা ছুঁড়ে ফেলা হলো। মামার গলা শোনা গেল–সব কয়টাকে খুন করে ফেলব। পাগল বানাতে বাকি রেখেছে। উফ!
সোবাহান নিচুস্বরে বলল, এরকম রোজ হয় নাকি?
রোজ হয় না, মাঝে মাঝে হয়। আমি বাজারে যেতে পারছি না। তাই রাগ উঠে গেছে।
রাগ কতক্ষণ থাকবে?
কিছু একটা না-ভাঙা পর্যন্ত থাকবে। তুই এখন উঠ প্লিজ।
চিকিৎসা করাচ্ছিস, না শুয়ে আছিস শুধু?
শুয়েই আছি। জণ্ডিসের কোনো চিকিৎসা নেই।
অড়হড়ের পাতা সিদ্ধ করে রস খা।
অড়হড়ের পাতা পাব কোথায়! যত ফালতু বাত। উঠ তো।
বুলু রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল। ক্লান্তস্বরে বলল, আর যাব না। হাঁটতে পারছি না। তুই এক কাজ কর, এই দুপুরে না খেয়ে যাবি কী। হোটেলে ভাত খেয়ে যা। পয়সা দিতে হবে না। বাকিতে খা, আমি পরে দিয়ে দেব।
দরকার নাই।
দরকার আছে। তুই যা। খাসির মাথা আর ডাল আছে। খারাপ না, ভালোই। আয় আমার সাথে, আমি বলে দেই–বিসমিল্লাহ হোটেল।
বুলু সোবাহানকে হোটেলে বসিয়ে চলে গেল। এই হোটেলে বুলু প্রায়ই খায়। বাসা ফেলে তাকে হোটেলে কেন খেতে হয় কে জানে!
সোবাহান দু’টার দিকে হোটেল থেকে বেরুল। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ছুটির দিন অফিস টফিস বন্ধ, নয়তো যে সব বন্ধুরা ঢাকায় চাকরি বাকরি করছে তাদের কাছে যাওয়া যেত। উত্তরা ব্যাংকের নিউ মার্কেট ব্রাঞ্চে আছে সফিক। তার কাছে গেলেই সে চা নাশতা খাওয়াবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফেরার পথে জোর করে পাঁচ টাকার একটা নোট পকেটে ঢুকিয়ে দেয়–এটা নাকি তাকে দেখতে আসার ফি। সফিক এটা যে শুধু সোবাহানের জন্যে করে তাই না, সবার জন্যে করে। সব বেকার বন্ধুদের জন্যে এই ব্যবস্থা। এ জন্যেই সফিকের কাছে যেতে ইচ্ছে করে না।
আবার উল্টো ধরনের চরিত্রও আছে। মতিঝিলের করিম। যে বেশ কিছুদিন ধরেই অফিস ম্যানেজার না কী যেন হয়ে বসে আছে। গরমের মধ্যে তাকে সার্ট ও টাই পরতে হয়। করিম এদের কাউকে দেখলেই বিরক্ত হয়ে বলে–কতদিন বলেছি অফিসটাইমে কেউ গল্প করতে আসে? তোদের কি মাথা টাথা খারাপ?
অফিসটাইম ছাড়া তোকে পাব কোথায়?
এখন যা, এখন যা। আমার কাজ আছে।
কী কাজ?
সদরঘাট যেতে হবে। একটা মাল ডেলিভারি নিতে হবে।
তোকে তো ধরে রাখছি না। তুই যা, আমরা ঠান্ডা ঘরে বসি খানিকক্ষণ। আড্ডা দেই। তুই তোর মাল নিয়ে আয়।