নামাজ শেষ কইরা আসেন তারপর বলি।
না, এখনই বলো। নামাজ শেষ করে আমি আজ আর বাড়ি ফিরব না। রাত কাটাব নামাজঘরে।
কেন?
ইবাদত বন্দেগি করব। ঘর তো সেজন্যেই বানালাম।
ভিতরের বাড়িতে ইবাদত বন্দেগি করা যায় না?
গণ্ডগোল হয়। মনে বসে না। বলো, তুমি কী বলতে চাও?
অন্যদিন বলব। আপনের নামাজের সময় হইছে। নামাজ পড়তে যান।
ফরিদ আলি বাংলাঘরে গিয়ে দেখেন নামাজ পড়ার জন্যে অনেকেই বসে আছে। তিনি বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, আজ থেকে একা একা আল্লাহকে ডাকবেন।
সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।
আপনারা কিছু মনে করবেন না।
জি-না জি-না। তবে আপনার দু’একটা কথা শুনতে বড় ভালো লাগে। মনে শান্তি হয়।
প্রতি বৃহস্পতিবার মাগরেবের পর আপনাদের সাথে কথা বলব।
জি আচ্ছা। জি আচ্ছা।
আর বলবই বা কী বলেন? আমি কী জানি? কিছুই জানি না। বোকার মতো যা মনে আসে বলি। আল্লাহর কাছে গুনাগার হই।
সমবেত মুসল্লিরা অভিভূত হয়ে পড়ে। তারা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। ফরিদ আলি নামাজঘরে ঢুকে পড়েন। ঘরের রহস্যময় আলো-আঁধার তাঁর বড় ভালো লাগে।
ভেতরবাড়িতে ফিরতে ফিরতে তাঁর রাত দশটা বেজে যায়। পারুল ভাত বেড়ে দেয়। তরকারি গরম করে আনে। ভাত মাখতে মাখতে ফরিদ আলি নিচুস্বরে কথা বলেন, কী যেন বলতে চেয়েছিলে?
তেমন কিছু না। আপনে ভাত খান। ডাইল নেন।
বলার থাকলে বলো।
পারুল অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, আপনে আরেকটা বিয়া করেন। সংসারে ছেলেপুলে আসলে মনে শান্তি আসে।
আমার মনে শান্তি আছে।
না, শান্তি থাকলে মানুষ এই রকম করে না।
কী করলাম আমি?
বিষয়সম্পত্তি বিক্রি করতেছেন। এইসব আপনের একার না। সোবাহানের অংশও আছে।
সোবাহানকে জিজ্ঞেস করেছি।
আপনে জিজ্ঞাস করলে সে না বলবে না। তবু এইটা উচিত না।
ফরিদ আলি গম্ভীর মুখে বললেন, আমি ধর্মকর্ম করি এটা চাও না তুমি?
ধর্মকর্ম নিয়া আপনি বাড়াবাড়ি করেন এইটা ঠিক না। মানুষের সংসারি হওয়া লাগে। আপনার উপর দায়িত্ব আছে।
কী দায়িত্ব?
সোবাহানের বিয়া দিবেন না?
তার বিয়ে ঠিক করে এসেছি। ওই নিয়ে চিন্তা করবার কিছু নাই। সব ঠিক আছে।
পারুল বিস্মিত হয়ে বলল, কোন জায়গায় ঠিক করলেন?
ঢাকায়। মেয়ের নাম যূথি। ভালো মেয়ে।
সোবাহান মেয়ে দেখছে? সে রাজি আছে?
রাজি অরাজির কী আছে? আল্লাহর ইচ্ছা থাকলে ওইখানে বিয়ে হবে। ইচ্ছা না থাকলে হবে না।
ওই মেয়ের কথা তো আমাকে কিছু বলেন নাই।
এই তো বললাম। আর কী জানতে চাও?
ফরিদ আলি উঠে পড়ে শান্তস্বরে বললেন, আজ রাতটা আমি নামাজঘরে কাটাব।
ওইখানেই ঘুমাবেন?
না, ঘুমাব না। এবাদত বন্দেগি করব।
রাতে আর ফিরবেন না?
ফজরের নামাজের শেষে ফিরব। আমাকে একটা পান দাও।
পারুল পান এনে দিল। ফরিদ আলি বিছানায় আধশোয়া হয়ে পান খেলেন। পারুল কিছুই বলল না।
নামাজঘরে ঢোকবার আগে ফরিদ আলি সোবাহানকে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখলেন।
তাঁর মনে আজ খুব আনন্দ। চিঠি লিখতে লিখতে তাঁর গভীর আবেগ উপস্থিত হলো। বেশ কয়েকবার তাঁকে চোখ মুছতে দেখা গেল। পারুল তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে। দীর্ঘ দিনের চেনা লোক কত দ্রুতই না অচেনা হয়ে যাচ্ছে! ফরিদ আলি চোখ তুলে তাকালেন। শান্তস্বরে বললেন, কী দেখছ?
না, কিছু না।
একটা চিঠি দিলাম সোবাহানকে। বিয়ের কথাটা লিখলাম। ওর বিয়ে হয়ে গেলে আমার একটা দায়িত্ব শেষ হয়। অজুর পানি দাও। অজু করে চলে যাব।
রাতে আসবেন?
না।
ফরিদ আলি উঠানে বসে অনেক সময় নিয়ে অজু করলেন। উঠানে ফকফকা জ্যোৎস্না। দেখতে খুব ভালো লাগে। পারুল দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তাঁকে দেখে। তাকে নতুন বিয়ে হওয়া কিশোরীর মতো লাগে।
প্রায় চৌদ্দ বছর হলো তাদের বিয়ে হয়েছে। পনেরোও হতে পারে। এত দীর্ঘ সময় তারা একসঙ্গে আছে এটা মনেই থাকে না। পারুলকে এখনো অচেনা লাগে।
বেলা এগারোটায় সোবাহান
বেলা এগারোটায় সোবাহান বুলুদের বাসার কড়া নাড়ল। আজ যে ছুটির দিন এটা সোবাহানের মনে ছিল না। বেকার যুবকরা দিনের হিসাব ঠিকমতো রাখতে পারে না। ছুটির দিনে বুলুদের বাসায় গেলে বুলু খুব রাগে। আজও নির্ঘাৎ রাগবে। দরজা খুললেন বুলুর মামা। ভদ্রলোক মিউনিসিপ্যালিটিতে কেরানিগিরি করেন। এত অল্প বেতনের চাকরিতেও তিনি কী করে এমন বিশাল একটি শরীর বানিয়েছেন কে জানে। বাংলাদেশী কিংকং। পালোয়ানদের মতো মাথাটা পর্যন্ত কামানো। সোবাহান কাঁচুমাচু মুখে বলল, বুলু আছে?
আছে। কেন?
একটু দরকার ছিল।
মামা বিরক্ত স্বরে ডাকতে লাগলেন, এই বুলু! বুলু!
বুলুর সাড়া পাওয়া গেল না।
ওর জ্বর, শুয়ে আছে বোধহয়। অন্য আরেকদিন এসো। নাকি কোনো বিশেষ দরকার?
বিশেষ দরকার। একটা চাকরির ব্যাপারে।
আর চাকরি–ওর কপালে চাকরি ফাঁকরি নাই। যাও ভেতরে চলে যাও। বুলুর ঘর চেনো তো?
চিনি।
বুলু চাঁদর গায়ে বিছানায় পড়ে ছিল। দাড়ি গোঁফ গজিয়ে সন্ন্যাসীর মতো লাগছে। সে বিরক্ত গলায় বলল, কতদিন বলেছি ছুটির দিনে আসবি না।
তোর কী হয়েছে?
জন্ডিস।
কতদিন হলো?
তা দিয়ে কী করবি? ওইদিন অসুখ শরীরে খবর দিয়ে এলাম–তুই একটা খোঁজ তো নিবি! কী ব্যাপার!
কী ব্যাপার?
বুলু জবাব দিল না। গম্ভীর হয়ে রইল।
সোবাহান সিগারেট বের করল। বুলু বিরক্ত মুখে বলল, সিগারেট ধরাস না।
কেন?
মামা রাগ করে।