সোবাহান ঘরে ফিরল রাত এগারোটায়। জলিল সাহেব বললেন, এত দেরি করলেন? আপনার বন্ধু বুলু সাহেব সন্ধ্যা থেকে বসে ছিলেন। খুব নাকি দরকার।
কী দরকার?
তা তো বলেন নাই, চিঠি লিখে গেছেন। ড্রয়ারে চিঠিটা আছে, পড়ে দেখেন।
চিঠিতে তেমন কিছু লেখা নাই। ইংরেজি বাংলা মিশানো যা আছে তার কোনে পরিষ্কার অর্থও হয় না। বোঝা যায় যে, একটা ইম্পর্টেন্ট খবর আছে। সে খবরটি কী সে সম্পর্কে কিছুই নাই।
জলিল সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, ব্যাপারটা কি কিছু বুঝতে পারছেন?
নাহ্।
খারাপ কিছু না তো?
না, খারাপ আর কী হবে? চাকরি হয়েছে বোধহয়।
চলেন না যাই খোঁজ নিয়ে আসি।
এত রাতে কোথায় যাব!
সোবাহান কোনো উৎসাহ দেখাল না। নির্বিকার ভঙ্গিতে ঘুমোতে গেল। ঘুম আসবে না জানা কথা। অনেক রাত জেগে থাকার পর খানিকটা তামতে হবে। ব্যস। কিংবা এও হতে পারে সারা রাত জেগে কাটবে।
রাত একটা পর্যন্ত ঘুমোবার চেষ্টা করে সোবাহান মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। জলিল সাহেব আলো জ্বালিয়ে কী যেন পড়ছেন।
কী পড়ছেন?
তেমন কিছু না রে ভাই। ফুটপাতের একটা বাজে বই। আপনার মতে ইয়াংম্যানদের পড়া ঠিক না।
জলিল সাহেব, আপনি কি কোনো মেয়েকে দেখে বলতে পারেন মেয়েটি বিবাহিতা অবিবাহিতা?
জলিল সাহেব খানিকক্ষণ কুঁচকে রেখে বললেন, বলাটা ডিফিকাল্ট। বলতে হলে বিছানায় নিতে হবে। হা হা হা।
সোবাহান বারান্দায় গিয়ে বসল। জলিল সাহেব ভেতর থেকে বললেন, কি ভাই রাগ করলেন নাকি? বয়স হয়েছে, দুএকটা বেফাঁস কথা বলে বসি। এতে মাইন্ড করা ঠিক না।
মাইন্ড করিনি।
আপনি কি ভাই বিবাহিতা কারুর সঙ্গে কিছু বাধিয়ে বসেছেন? সিংকিং সিংকিং ড্রিকিং ওয়াটার। সুখে আছেন ভাই। বয়সটাই আপনাদের ফেভারে। জীবনটা কেটে গেল ভেজিটেবলের মতো। বহুত আফসোস হয়, বুঝলেন?
জলিল সাহেব বারান্দায় এসে বসলেন। সিগারেট ধরালেন। ক্লান্ত স্বরে বললেন, ফ্যামিলি লাইফের একটা চার্ম আছে। এই ধরেন, ফ্যামিলি থাকলে এ সময়ে লেবুর শরবত বানিয়ে খাওয়াত। মাথা টিপে দিত।
সোবাহান বলল, আপনার মাথা ধরেছে নাকি?
জলিল সাহেব জবাব দিলেন না।
মাথা ধরা থাকলে সিগারেট খাবেন না।
মাথা ধরে নাই। কটা বাজে?
একটার উপরে।
সামনের রাস্তায় লোক চলাচল নেই। গলির মোড়ের সিগারেটের দোকান একটার। দিকে ঝাঁপ ফেলে দেয়। আজ ফেলছে না। অল্পবয়েসী কিছু ছোঁকরা ঘোরাঘুরি করছে সেখানে। জলিল সাহেব ওই দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বললেন, ওদের মতলবটা কিছু বুঝতে পারছেন?
জি-না।
গাঁজা খাবে। রাত একটার পর ওই দোকানে গাঁজা বিক্রি হয়।
তাই নাকি?
হুঁ। খাবেন নাকি?
নাহ্।
ইচ্ছা হলে চলেন যাই, দেখি জিনিসটা কী! দু’টাকা করে নেয়। সিগারেটের মধ্যে ভরে দেয়।
না, ইচ্ছা করছে না।
সবকিছু ট্রাই করতে হয়। জীবনে আছে কী বলেন? মরবার সঙ্গে সঙ্গেই তো ফুটটুস। কি ঠিক বললাম না?
জি ঠিকই বলেছেন।
আচ্ছা ঠিক আছে, চলেন যাই চা খেয়ে আসি।
রাতে চা কোথায় পাবেন?
ঢাকা শহরে একটার সময় চা পাওয়া যাবে না? বলেন কী? যান সার্টটা গায়ে দিয়ে আসেন।
বড় রাস্তায় দুটি চায়ের দোকান ভোলা পাওয়া গেল। একটিতে ইংরেজি গানের ক্যাসেট বাজানো হচ্ছে। জলিল সাহেব গানের দোকানটিতেই বসলেন। চা খাওয়া শেষ হওয়ার পরও বসে রইলেন। সোবাহান বলল, যাবেন না?
আরে বসেন না, গান শুনি। বাড়িতে গিয়ে তো সেই ঘুমাবেন। ভালোই লাগছে তো গান শুনতে। লাগছে না?
সোবাহান কিছু বলল না।
বেঁচে থাকতে হলে আনন্দ দরকার। চা খাবেন আরেক কাপ?
জি-না।
দৈ খাবেন? খান, পয়সা আমি দেব।
জি-না। আমি উঠব, ঘুম পাচ্ছে। আপনি কি আরও কিছুক্ষণ বসবেন?
বসি কিছু সময়। ঘরে গিয়ে করবটা কী?
জলিল সাহেব আরেক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে গানের তালে মাথা নাড়তে লাগলেন। যেন খুব মজা পাচ্ছেন।
সোবাহানের মনে হলো–বেচারাকে ফেলে আসাটা ঠিক হয়নি। আরও খানিকক্ষণ বসলেই হতো। ঘরে গিয়ে তো ঘুমানো যাবে না। দরজা খুলবার জন্যে জেগে থাকতে হবে। তিনি কখন আসবেন তারও ঠিক নেই। দোকান বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত বসে থাকবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই।
.
১০.
নামাজঘরটি ফরিদ আলির পছন্দ হয়েছে।
একটি মাত্র দরজার গোলাকার ছোট্ট ঘর। মেঝে মোজাইক করার ইচ্ছা ছিল—টাকার টান পড়ে গেল। তাতে ক্ষতি হয়নি। কালো সিমেন্টের প্রলেপে ভালোই লাগছে দেখতে।
ঘরের ভেতরটা দিনের বেলাতেও অন্ধকার। অন্ধকার বলেই রহস্যময়। উপাসনার ঘর রহস্যময় হওয়াই তো উচিত। বসতবাড়ি থেকে পঞ্চাশ গজের মতো দূরে। এটাও ভালো। সংসারের কোলাহল থেকে দূরে থাকাই ভালো।
ফরিদ আলি সমস্ত দুপুর সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে ঘরের মেঝে পরিষ্কার করলেন। তার বাড়ির কামলা রোস্তম বলল, আমি সাফ কইরা দেই বড় মিয়া? ফরিদ আলি বললেন, না। এই ঘরে আমি ছাড়া কেউ ঢুকবে না।
রোস্তম তাকাল অবাক হয়ে।
নির্জনে আল্লাহ খোদার নাম নিতে চাই রোস্তম। নির্জনেই আল্লাহকে ডাকা উচিত। উচিত না?
জি উচিত।
সন্ধ্যাবেলা ফরিদ আলি ভেতরবাড়িতে অজু করতে গেলেন। অজুর পানি দিতে দিতে পারুল বলল, আপনের সাথে আমার কথা আছে।
ফরিদ আলির কপালে ভাঁজ পড়ল। পারুল তাকে তুমি করে বলত। এখন আপনি করে বলছে। রোজই ভাবেন জিজ্ঞেস করবেন–এর কারণটি কী? জিজ্ঞেস করা হয় না। লজ্জা লাগে। ফরিদ আলি অজু শেষ করে বললেন, বলো কী বলবে?