সমবেত প্রতিটি মানুষ একসঙ্গে বলল, আমাদের ভালো করেন। বুলুও বলল।
গভীর রাতে জিগির শুরু হলো, তবে ফরিদ আলি জিগিরে সামিল হলেন না। তিনি তাঁর নামাজঘরে ঢুকে পড়লেন। সেখানে কোনো বাতি জ্বালানো হলো না। অন্ধকারে ছোট্ট ঘরটিতে তিনি এক রহস্যময় পুরুষের মতো বসে রইলেন। বাংলাঘরের মুসল্লিরা। তালে তালে আল্লাহু আল্লাহু করতে লাগল। তাদের মাথা নড়ছে গা কাঁপছে। চোখমুখ আনন্দে উদ্ভাসিত। যারা এখানে জমা হয়েছে তারা সবাই কি রাতে ভরপেট খেয়েছে? বোধহয় না। অনাহারক্লিষ্ট মুখ দেখলেই টের পাওয়া যায়। এরা কি এখানে ক্ষুধা ভুলে থাকার জন্যে এসেছে? বুলু জিগির করার ফাঁকে ফাঁকে গভীর আগ্রহে সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগল। তার বড় ভালো লাগছে।
এক সপ্তাহ থাকার কথা ছিল। তৃতীয় দিনেই সোবাহান ঠিক করল চলে আসবে। ফরিদ আলি বেশ কয়েকবার থাকতে বললেন। সোবাহান প্রতিবারই বলল, না আমার ভালো লাগছে না।
কী, ভালো লাগছে না?
এইসব জিগির ফিগির।
না হয় এই কদিন জিগির হবে না। সবদিন তো হয়ও না।
সোবাহান ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, আপনি সারা রাত ওই বাংলাঘরে বসে থাকেন কেন? মানুষের ঘুমের দরকার নাই?
ঘুমাই তো। দিনে ঘুমাই।
বুলুর আরও কিছুদিন থাকার ইচ্ছা ছিল। সোবাহান তাকে নিয়ে জোর করে চলে এল। ফরিদ আলি স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলেন। সারা পথে অসংখ্য লোক তাকে সালাম করল। একজন এগিয়ে এল ছাতা হাতে। রোদে যেন তার কষ্ট না হয়। তিনি মৃদু হেসে তাকে বললেন, রোদ তো আল্লাহর দান। রোদে কষ্ট হবে কেন? কোনো কিছুতেই কষ্ট নাই। কষ্ট মনে করলেই কষ্ট! সুখ মনে করলেই সুখ!
.
সোবাহান অফিসে ঢোকামাত্র রিসিপিশনের মেয়েটি বলল, আপনি অনেকদিন পরে এলেন। কী ব্যাপার, অসুখ-বিসুখ নাকি?
সোবাহান অবাক হলো। ব্যাপারটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
বড় সাহেব আপনার খোঁজ করছিলেন।
উনি কি আছেন?
আছেন। আপনি বসুন। খবর পাঠাচ্ছি।
সে বসে রইল। রিসিপশনের মেয়েটিকে আজ আরও সুন্দর লাগছে। আজ সে। কালো রঙের একটি শাড়ি পরেছে। কালো রঙের শাড়িতে মেয়েদের এতটা সুন্দর লাগে তা তার জানা ছিল না।
যান, আপনি স্যারের ঘরে যান।
রহমান সাহেবের বয়স প্রায় পঞ্চাশ। মাথার চুল সব পেকে গিয়েছে। অসম্ভব গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। কথা বলবার সময় চোখে পলক পড়ে না। এদের দেখলেই মনে হয় এরা। জন্মেছে বস হওয়ার জন্যে।
বসুন। আপনার নাম সোবাহান?
জি।
ওইদিন আপনি এরকম অশালীন আচরণ করলেন কেন? একজন মেয়েমানুষকে অপমান করে পৌরুষ দেখালেন?
সোবাহান জবাব দিল না। লোকটির ব্যক্তিত্বের তারিফ করল মনে মনে।
আপনি পড়াশুনা কতদূর করেছেন?
বিএ পাস করেছি।
কোন ক্লাস?
সেকেন্ড ক্লাস।
যে মহিলাদের সম্মান দেখাতে জানে না তাকে আমি এই অর্গানাইজেশনে চাকরি দিতে পারি না।
সম্মান অর্জন করতে হয়। অনেক মহিলা আছেন যাদের সম্মান দেখানোর কোনো কারণ নেই।
আপনি যেতে পারেন।
সোবাহান উঠে দাঁড়াল। রহমান সাহেব বেল টিপতেই পিএ ছুটে এল এবং এমন ভাব করল যেন সে সোবাহানকে চিনতে পারছে না। রহমান সাহেব বললেন, ফরেন করেসপনডেন্স ফাইলে কোরিয়া ট্রেডার্সের কোনো চিঠি আছে কি না দেখুন তো।
সোবাহান লোকটির ব্যক্তিত্বের আবার প্রশংসা করল। লোকটি কত সহজেই বুঝিয়ে দিল–তুমি কীটস্য কীট। সোবাহান হাসিমুখে বলল, স্লমালিকুম।
রহমান সাহেব চোখ তুলে তাকালেন। শীতল স্বরে বললেন, আপনি নিচে অপেক্ষা করুন, আমি ডাকব।
সে নিচে নেমে এল। রিসিপশনের মেয়েটি কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। যাওয়ার সময় তাকে কি কিছু বলে যাওয়া উচিত? এখানে আর তো নিশ্চয়ই আসা হবে না। সোবাহান ইতস্তত করতে লাগল। কিন্তু কথা শেষ হচ্ছে না। বেশ মেয়েটি।
চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
স্যার কী বললেন?
তেমন কিছু না।
মেয়েটি মনে হলো বেশ অবাক হয়েছে। অবাক হওয়ার কিছু কি আছে এর মধ্যে?
সোবাহান হঠাৎ বলে বসল, আপনার নাম জানা হয়নি।
আমার নাম ইয়াসমিন। নাম দিয়ে কী করবেন?
এমনি জিজ্ঞেস করলাম। কিছু মনে করবেন না।
চা খাবেন?
নাহ্।
খান, এক কাপ চা খান।
মেয়েটি কাকে যেন ইশারা করল। হালকা গলায় বলল, আমার ধারণা ছিল আপনার। চাকরিটা হবে।
এরকম ধারণার কারণ কী?
কারণ স্যারকে দেখলাম আপনাকে নামে চেনেন। আমাকে বলে রেখেছিলেন সোবাহান নামের কেউ এলে তাকে খবর দিতে। আপনার নিশ্চয়ই ভালো রেফারেন্স আছে।
নাহ, তেমন ভালো নেই। থাকলে এ অবস্থা হওয়ার কথা না।
তাও ঠিক।
সোবাহান লক্ষ করল মেয়েটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। কী দেখছে কে জানে। দেখার মতো কী আছে তার মধ্যে?
আপনি রুমাকে যে ট্রিটমেন্ট দিয়েছেন তাতে আমরা সবাই খুব খুশি। থ্যাংকস।
রুমা কে? রহমান সাহেবের পিএ?
হ্যাঁ।
সোবাহান বেতের সোফায় বসে রইল সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যাবেলা পিএ এসে বলল, আজ দেখা হবে না। স্যারের প্রেসার বেড়েছে।
সোবাহানের চোখের সামনেই রহমান সাহেব বের হয় গেলেন। পলকের জন্যে তাকালেন সোবাহানের দিকে।
রিসিপশনিস্ট মেয়েটি বলল, আপনি পরশু আসুন। একটা কিছু নিশ্চয়ই হবে।
দেখি।
না, দেখাদেখি না। আসুন। এত অল্পতে ধৈর্য হারানো ঠিক না।
ধৈর্য আছে। এখনো হারাইনি।
তারা দুজন একসঙ্গে বেরুল। সোবাহান পাশাপাশি হাঁটছিল। তার ইচ্ছা হচ্ছিল বলে–কোনো রেস্টুরেন্টে বসে এক কাপ চা খাবেন? কিন্তু বলল না। বাংলাদেশে মেয়েরা সন্ধ্যাবেলা কোনো রেস্টুরেন্টে বসে চা খায় না। সোবাহান বলল–আচ্ছা চলি? মেয়েটি মিষ্টি করে হাসল। হয়তো অভ্যাসের হাসি, তবু দেখতে ভালো লাগে। এই মেয়েটির দাঁতগুলি সুন্দর। কোন টুথপেস্ট ব্যবহার করে কে জানে।