হুজুর, ছেলেটা বাঁচবে?
ফরিদ আলি তাকালেন। খুব স্পষ্টভাবে বললেন, মানুষের মৃত্যু নাই। আত্মা বেঁচে থাকে। আত্মার কোনো বিনাশ নাই। মৃত্যুর কথা বলছেন কেন?
কথাটা বলে তার নিজেরও ভালো লাগল। সত্যিই তো মৃত্যু নিয়ে এত যে মাতামাতি তার কোনো অর্থ হয় না। আমরা সবাই এক মৃত্যুহীন জগতের বাসিন্দা।
আপনার ছেলেটার বয়স কত?
জোয়ান ছেলে, বিয়ে দিছি গত বৎসর।
কী হয়েছে?
জানি না হুজুর। রক্তবমি করতেছে।
হুজুর বলছেন কেন আমাকে? আমার নাম ফরিদ আলি। আমাকে নাম ধরে। ডাকবেন।
লোক দু’টি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল।
আল্লার নামের সাথে মিল রেখে আমাদের নাম। কাজেই নাম ধরে ডাকলে কোনো অপমান হওয়া ঠিক না। আপনারা হাত-মুখ ধোন, বিশ্রাম করেন, খানা আসবে।
.
এই গ্রামে একটি পাকা মসজিদ আছে।
ফরিদ আলি আগে মসজিদে যেতেন। গত কয়েক মাস ধরে যান না। বাংলাঘরে একা একা নামাজ পড়েন। ইদানীং অবশ্য একা একা নামাজ পড়া হয় না। অনেকেই এখানেই চলে আসে। কেন আসে? তিনি জানেন না, জানতেও চান না। নামাজের শেষে মাঝে মাঝে দু’একটা কথা বলতে চেষ্টা করেন। সেগুলি কি ওদের ভালো লাগে? বোধহয় লাগে। আজও দেখা গেল অনেকেই এসেছে। নামাজের শেষে তিনি অন্যদিনের। মতো কিছু কথাবার্তা বললেন
সুখ ভোগ করবার জন্যে আমরা আসি নাই। পৃথিবীতে সুখ নাইরে ভাই। চারদিকে দুঃখ আর কষ্ট। এখানে কেউ কি আছেন যিনি বলতে পারেন তার কোনো দুঃখ নাই। আছেন কেউ?
মৃদু একটা গুঞ্জন উঠল। নবীনগর থেকে আসা লোকটি চোখ মুছতে লাগল। কথা বলতে বলতে ফরিদ আলির মনে গভীর আবেগের সৃষ্টি হলো এবং তার নিজের চোখ দিয়েও টপ টপ করে পানি পড়তে লাগল
এমন কেউ কি আছেন যিনি আমাদের দুঃখহীন জগতে নিয়ে যাবেন? যে জগতে মৃত্যু নাই, ক্লান্তি নাই। দুঃখ নাই। হতাশা নাই। বঞ্চনা নাই।
ফরিদ আলি কথা শেষ করে যখন উঠলেন তখন অনেক রাত। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। নবীনগরের লোক দুটিকে রাতে থেকে যেতে বলা হলো। তারা থাকল না। যাওয়ার সময় তারা আবার তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করতে এল। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও কাছে মাথা নিচু করা ঠিক না। তারা কী করবে বুঝতে পারল না। ফরিদ আলি বললেন, চলেন আপনাদের একটু এগিয়ে দিয়ে আসি।
জি-না, জি-না। হুজুর, লাগবে না।
ফরিদ আলি তাদের কথা শুনলেন না। তাদের এগিয়ে দিলেন নিমাই খালের পুল পর্যন্ত। জায়গাটা ঘন অন্ধকার। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ফরিদ আলি আকাশের দিকে তাকালেন। তারপর হঠাৎ বলে ফেললেন–চিন্তা করবেন না, আপনার ছেলে ভালো হয়ে যাবে। এই কথাটা কেন বললেন তিনি বুঝতে পারলেন না। কিন্তু বলেই সংকুচিত হয়ে পড়লেন।
এই কথাটি কেন তিনি বললেন? কেন, কেন? তারা অবাক হয়ে তাকাল তাঁর দিকে। অন্ধকারে তাঁর মুখ দেখা গেল না। লোকটি তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। ফরিদ আলি গাঢ় স্বরে বললেন, ভয়ের কিছু নাই, যান, বাড়ি যান।
বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ফরিদ আলি ভিজতে ভিজতে রওনা হলেন। বেশ লাগছে। তাঁর। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার গা বেয়ে পানি পড়তে লাগল। তিনি বাড়ির দিকে না গিয়ে উল্টোদিকে রওনা হলেন। সেখানে একটা শিমুল গাছ আছে। তার নিচে বসে থাকতে কেমন লাগে এটাই তার দেখার ইচ্ছা। কিংবা তেমন কোনো ইচ্ছা নেই, বসার জন্যেই বসা।
ঘণ্টাখানিকের মধ্যে বৃষ্টি থেমে গেল। তারও বেশ কিছুক্ষণ পর হারিকেন হাতে তাকে খুঁজতে এল বাড়ির কামলা। ফরিদ আলি হাসি মুখে বললেন, কিরে রশীদ?
রশীদ বলল, ছোড ভাই আইছে।
তাই নাকি?
জি। সঙ্গে তাইনের বন্ধু আছে।
ফরিদ আলির মন আনন্দে ভরে গেল। তিনি উল্লসিত বোধ করলেন।
.
০৯.
বুলু মুগ্ধ হয়ে গেল–আরে এ তো দেখি পোবন! সোবাহান নিজেও কম অবাক হয়নি। বাড়িঘর চেনা যাচ্ছে না। ঝকঝক তকতক করছে। নামাজঘরের সামনে চমৎকার বাগান। করা হয়েছে। বাড়ির উত্তরের বিশাল আমগাছটির নিচে লাল সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। বুলু বলল, কেমন যেন শান্তি শান্তি ভাব চলে আসছে। থেকে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।
থেকে যা। দাড়ি রেখে মুরিদ হয়ে যা।
তুই মনে হচ্ছে বিরক্ত।
বিরক্ত ফিরক্ত না।
সন্ধ্যাবেলা অনেক লোকজন এল ফরিদ আলির কাছে। বুলু মহা উৎসাহে গেল কথাবার্তা শুনতে। সোবাহান বসে রইল গম্ভীর হয়ে। ভাবি বললেন–তুমি যাও, শুনে আসো। আমাদের বলো। মেয়েমানুষেরা তো আর শুনতে পারে না।
বহু লোকজন আসে নাকি ভাবি?
তা আসে। বড় বড় লোকজনও আসে।
বড় বড় লোকজন মানে?
গত সপ্তায় এক জজ সাহেব আসছিলেন।
বলো কী?
জিপ গাড়ি নিয়ে এসেছে। রাত আটটা পর্যন্ত ছিল।
জ্ঞানের কথা সব শুনল?
কী কথা শুনল জানি না। আমি মূর্খ মেয়েমানুষ। এত সব কি জানি?
বুলু খুব আগ্রহ নিয়ে বক্তৃতা শুনল। ফরিদ আলি কখনো মৃদুস্বরে কখনো নিচুগলায় কথা বলতে লাগলেন
মানুষ পশুর মতো, তবে পশুর মধ্যেও ভালো জিনিস থাকে। যেমন বাঘ। বাঘের ভালো জিনিসটা হচ্ছে তার সাহস। সেরকম মানুষের মধ্যে, খারাপ জিনিসের মধ্যে অনেক ভালো জিনিস থাকে। ওই ভালোটা রেখে খারাপটা বাদ দিতে হবে। রসুল করিম হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলয়হেস সাল্লামের মধ্যেও কিছু খারাপ জিনিস ছিল। সেই জন্যে ফিরিশতা পাঠায়ে আল্লাহপাক তার বুক কেটে সেটা পরিষ্কার করলেন। আর আমরা তো অতি নিম্নশ্রেণীর মানুষ, আমাদের মধ্যে খারাপ ভাবটা আরও বেশি। কাজেই রাত দিন আল্লাহপাকের কাছে আমাদের বলতে হবে, হে পাওয়ারদেগার, আমাদের ভালো করেন।