মৃত্যুর পর যেন চোখ দুটির দেখার শক্তি অনেক বেড়ে গেছে। এরকম মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই, তবু মনে হয়। সোবাহান মিলিদের বাড়ির দিকে রওনা হলো।
.
আরে সোবাহান ভাই, আপনি!
কেমন আছ?
ইস! এই রোদের মধ্যে কেউ আসে? হেঁটে এসেছেন, না?
ঘুমাচ্ছিলে নাকি?
আমি দিনে ঘুমাই না। যেসব মেয়ের বয়স একুশ তারা দুপুরে ঘুমায় না।
মিলি, ঠান্ডা দেখে এক গ্লাস পানি দাও।
একটু বিশ্রাম করে নিন। এখন ঠান্ডা পানি খেলে সর্দি-গর্মি হবে। আসেন বারান্দায়। বসেন। বারান্দায় ঠান্ডা।
সোবাহান বারান্দায় বসে রইল। গা দিয়ে আগুনের হল্কা বেরুচ্ছে। পুকুরে গলা। পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। মিলি তাকিয়ে আছে। কে বলবে এই মেয়ের বয়স একুশ। পনেরো-ষোল বছরের কিশোরীর মতো লাগছে। ভারী মিষ্টি একটি মুখ।
একটা টেবিল ফ্যান এনে দেই? নাকি ঘরের ভেতর ফ্যানের নিচে বসবেন?
এখানেই বসব। তুমি পানি আন।
মিলি পানি আনতে গেল। সোবাহান হাত-পা ছড়িয়ে এলিয়ে পড়ল। মাঝে মাঝে সে আসে এ বাড়িতে। আসার তেমন কোনো কারণ নেই। মিলির বড় ভাইয়ের বন্ধু, সেই সূত্রে আসে।
নিন, পানি নিন।
শুধু পানি নয়, একটা প্লেটে দুটি সন্দেশ। সোবাহান লোভীর মতো সন্দেশ খেল। তার এতটা ক্ষিধে পেয়েছে আগে বোঝা যায়নি। মিলি সহজ স্বরে বলল, আপনি দুপুরে কিছু খাননি, তাই না?
হুঁ।
কেন, খাননি কেন?
সোবাহান না খাওয়ার কারণটা ব্যাখ্যা করল না। আরেক গ্লাস পানি চাইল। মিলি বড় একটা কাঁচের জগে পানি নিয়ে এল। পানির ওপর বরফের টুকরো ভাসছে। কাঁচের জগটি ঝকঝক করছে। বিন্দু বিন্দু পানি জমেছে চারপাশে দেখেই তৃষ্ণা কমে যায়।
সোবাহান ভাই, আপনি দুমাস পরে এলেন। আপনার কথা মা প্রায়ই বলেন।
খালা কেমন আছেন?
ভালো না।
এখনো কান্নাকাটি করেন?
হুঁ। এবং এখনো বিশ্বাস করেন ভাইয়া বেঁচে আছে। মিলিটারিরা তাকে পাকিস্তানে নিয়ে বন্দি করে রেখেছে।
বেশির ভাগ মা-ই তাই ভাবে। আমার নিজেরও মাঝে মাঝে মনে হয় ও হয়তো বেঁচেই আছে।
মিলি ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। শান্ত স্বরে বলল, খেতে আসুন সোবাহান ভাই। খাবার দেওয়া হয়েছে।
খাবার দেওয়া হয়েছে মানে?
দুপুরে তো খাননি। টেবিলে ভাত দিতে বলেছি।
চারটার সময় ভাত খেতে বসব নাকি?
হ্যাঁ বসবেন। আসুন। সিগারেট ফেলে দিন।
শোনো, মিলি।
অল্প চারটা খান। আসুন।
সোবাহানকে উঠতে হলো। হাত-মুখ ধুয়ে ভাত নিয়ে বসতে হলো। কাজের মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে দূরে। মিলি তার ধবধবে ফর্সা হাতে ভাত বেড়ে দিচ্ছে। হাতভর্তি লাল টকটকে কাঁচের চুড়ি। অদ্ভুত সুন্দর একটা ছবি। স্বপ্নদৃশ্যের মতো।
মিলি, বাসায় কেউ নাই?
না। আব্বা আম্মা খালার বাসায় গেছেন। ছ’টার মধ্যে এসে পড়বেন। আপনি কিন্তু মার সঙ্গে দেখা না করে যেতে পারবেন না।
আরেকদিন আসব। আজ আমার যেতে হবে এক জায়গায়।
আপনি এলে মার সঙ্গে দেখা করতে চান না।
সোবাহান চুপ করে রইল। মিলি বলল, মা আপনাকে দেখলেই কান্নাকাটি করে তাই আপনার ভালো লাগে না। ঠিক না?
সোবাহান জবাব দিল না। মিলি বলল, এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন? আস্তে আস্তে খান। ডাল নিয়ে ভালো করে মাখুন। শুকনা শুকনা খাচ্ছেন কেন?
সোবাহান কী একটা বলতে গিয়েও বলল না। মিলি বলল, চাকরির কিছু হয়েছে আপনার?
নাহ।
মা যে আপনাকে এক ভদ্রলোকের কাছে যেতে বলেছিলেন, যাননি? রহমান সাহেব কে যেন।
এখনো দেখা হয়নি।
দেখা করবেন। আপনার চাকরি হবে।
আমার কিছু হবে টবে না মিলি। আমি গ্রামে চলে যাব।
এখনই হাল ছেড়ে দিচ্ছেন?
অনেকদিন চেষ্টা করলাম। আর ভালো লাগে না। উঠি মিলি?
মিলি তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিল। রোদের তাপ কমে এসেছে। ঠাণ্ডা বাতাস, দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে হয়তো। সোবাহান বড় রাস্তায় নেমে একবার পেছনে তাকাল। মিলি দাঁড়িয়ে আছে। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে একধরনের কাঠিন্য আছে। সোবাহানের তবু মনে হলো, ঠিক এ ধরনের মেয়েদের কাছেই বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে।
একটা ভুল হয়ে গেল। মিলির বর কবে আসবে জিজ্ঞেস করা হয়নি। শিগগিরই তো আসার কথা। মিলির বরকে মিলি চোখে দেখেনি। বিয়ে হয়েছে টেলিফোনে। ভদ্রলোক মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি। মিলির মতো একটি মেয়েকে পাশে পাওয়ার জন্যে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি করতে ইচ্ছা করে। মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং জিনিসটা কী?
.
০৮.
ফরিদ আলির কাছে দু’জন লোক এসেছে নবীনগর থেকে। তিনি তাদের চিনতে পারলেন না। তারা বয়সে ফরিদ আলির কাছাকাছি, কিন্তু দেখা হওয়ামাত্র পা ছুঁয়ে সালাম করল। ফরিদ আলি যথেষ্ট অপ্রস্তুত হলেন। এর জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না। লোক দুটির একজন কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, হুজুর, আপনার দোয়া নিতে এসেছি।
ফরিদ আলি খানিকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না। কিছুদিন ধরেই তার কাছে দূর দূর থেকে মানুষজন আসে। গত সপ্তাহেই নান্দাইল রোড থেকে একজন প্রাইমারি স্কুলের টিচার তাঁর ছোট মেয়েটিকে নিয়ে এসেছিল। সেদিনও তিনি বলেছিলেন–”আমার কাছে কেন এসেছেন? আমি একজন অতি নগণ্য ব্যক্তি। আজও সেই কথা বললেন।
লোক দু’টি কী শুনে তাঁর কাছে এসেছে কে জানে। তারা জড়সড় হয়ে বসে রইল।
আপনারা নিশ্চয়ই খাওয়াদাওয়া করেন নাই?
জি-না।
বসেন। খাওয়াদাওয়া করেন। মাগরেবের নামাজের পর দোয়া করব।