তুমি শিক্ষিত ছেলে হইয়াও জমি বিক্রয়ের বিষয়ে নীরব থাকিলে। আমার সঙ্গে তোমার ভাই কোনো পরামর্শ করে নাই। কারণ মেয়েদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ তিনি করেন না। মেয়েদের পরামর্শে সংসার চলিলে নাকি সংসারে আয় উন্নতি হয় না।
জমি বিক্রয়ের টাকায় নামাজঘর তৈরি হইতেছে। নামাজঘর হইল একটা পাকা কোঠা। সেখানে তোমার ভাই এবাদত বন্দেগি করিবেন। এবাদতের জন্যে পাকা ঘর লাগে তাহা জানিতাম না। আমরা মেয়েমানুষেরা অনেক কিছু জানি না।
সংসারে নানান ঝামেলা। পরামর্শ করিবার কেহ নাই। তুমি আসিলে ভালো হইত। শুনলাম তোমার শরীরও নাকি খুব খারাপ হইয়াছে। হোটেলে খাওয়া–শরীর নষ্ট হইবে জানা কথা। তুমি ভাই কয়েকদিন আমাদের সঙ্গে থাক। তোমার ভাইয়ের নামাজঘর দেখিয়া যাও। আল্লাহ তোমাকে সুখে শান্তিতে রাখুক।
তোমার ভাবি
সোবাহান লক্ষ করল চিঠিতে যূথির কথা নেই। তার মানে ভাইসাহেব এই প্রসঙ্গে কিছু বলেননি। অদ্ভুত লোক!
কার চিঠি এত মন দিয়ে পড়ছেন?
ভাবির চিঠি।
ফরিদ সাহেবের স্ত্রী?
জি।
সুন্দর হাতের লেখা।
সোবাহান চিঠি পকেটে রেখে দিল। জলিল সাহেব বললেন, কোথাও যাচ্ছেন নাকি?
জি।
আরে, ছুটির দিনে কোথায় যাবেন? বসেন, গল্পগুজব করি।
কাজ আছে।
আরে ভাই রাখেন কাজ। চলেন ভিসিআর দেখে আসি। আমার চেনা জায়গা।
আরেকদিন যাব।
আরে না, আরেকদিন আবার কী! চলেন যাই। এমন জিনিস দেখবেন জীবনে ভুলবেন না। মারাত্মক ছবি।
সোবাহানকে বেরুতে হলো তার সঙ্গে। বারান্দায় যূথি দাঁড়িয়ে ছিল। জলিল সাহেব হাসিমুখে বললেন, কেমন আছ?
মেয়েটা অস্পষ্টভাবে কী যেন বলল ঠিক বোঝা গেল না।
তোমরা বাইরের মানুষদের দাওয়াত করে খাওয়াও। আমাদের কথা তো মনে করো না। আমাদেরও তো মাঝে মাঝে ভালোমন্দ খেতে ইচ্ছা করে। কী বলেন সোবাহান। সাহেব? করে না?
সোবাহান অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। রাস্তায় নেমে জলিল সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, মেয়েটা অপুষ্ট কিন্তু তার বুক কেমন ডেভেলপ লক্ষ করেছেন। এর কারণটা বলতে পারেন? পারবেন না? হা হা হা! দুনিয়ার হালচাল কিছু দেখি জানেন না। আজকের দিনটা সময় দিলাম, দেখেন ভেবে-টেবে বের করতে পারেন কি না।
.
মগবাজার চৌধুরীপাড়ার বাড়িটা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বের করা গেল না। সোবাহান বিরক্ত হয়ে বলল, বাড়ি চিনেন না নিয়ে এলেন কেন?
আরে ভাই চিনি। চিনব না কেন? রাতের বেলা এসেছিলাম, তাই ঠিক ইয়ে হচ্ছে না। বাড়ির সামনে লোহার গেট।
লোহার গেট তো সব বাড়ির সামনেই।
তাও ঠিক।
ঘণ্টাখানিক খোঁজাখুঁজি চলল। জলিল সাহেব হাল ছাড়ার পাত্র নন। সোবাহান বলল, বাদ দেন, চলেন ফিরে যাই।
ফিরে গিয়ে তো সেই শুয়েই থাকবেন। আসেন আরেকটু দেখি। এই গলিটা চেনা লাগছে।
চেনা গলিতেও কিছু পাওয়া গেল না। জলিল সাহেবও একসময় হাল ছেড়ে দিলেন। ক্লান্ত স্বরে বললেন, লাচ্ছি খাবেন নাকি?
নাহ।
আরে ভাই খান, আমি পয়সা দেব।
পয়সা আমার কাছে আছে, আপনার দিতে হবে না। ইচ্ছে করছে না।
আরে চলেন চলেন।
লাচ্ছির দোকানটিতে ভিড় নেই। দৈয়ের উচ্ছিষ্ট খুড়িগুলিতে মোটা মোটা মাছি ভনভন করছে। ঘরের ভেতরে ভ্যাপসা গরম, তবে মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। ফ্যানের বাতাসও গরম।
জলিল সাহেব এক গ্লাস লাচ্ছি শেষ করতে আধা ঘণ্টা সময় নিলেন। লাচ্ছি শেষ করে পান আনালেন, সিগারেট আনালেন। ক্লান্ত স্বরে বললেন, বুড়ো হয়ে গেছি, বুঝলেন। ছুটির দিনগুলিতে কী করব বুঝতে পারি না।
বিশ্রাম করেন।
বিশ্রাম করেই বা হবেটা কী? সংসার দরকার। ঝামেলা দরকার। ঝামেলা অশান্তি এইসব না থাকলে বেঁচে থাকা যায় না। পান খাবেন নাকি একটা? মুখের মিষ্টি ভাবটা যাবে।
জি-না, খাব না।
এই তো দেখেন না আমার সংসারের কোনো দায়দায়িত্ব নাই। ছোট বোন ছিল বিয়ে দিয়েছি। এখন আমার দিন চলে না। দুপুরবেলা দৈয়ের দোকানে বসে থাকি।
জলিল সাহেব, আমি এখন যাব।
সোবাহান উঠে দাঁড়াল।
আরে এই রোদের মধ্যে কী যাবেন? বসেন বসেন, রোদ কমুক। আরেকটা লাচ্ছি খান।
আপনি খান।
সোবাহান রাস্তায় নেমে পড়ল। জলিল সাহেব লাচ্ছির শূন্য গ্লাস সামনে নিয়ে বসে রইলেন। তাকে ঘিরে নীল রঙের পুরুষ্ট মাছিরা উড়তে লাগল।
দুপুরে কোথাও যাওয়া যায় না। দুপুর হচ্ছে গৃহবন্দির কাল। সোবাহান উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরল অনেকক্ষণ। আজও তার দুপুরে খাওয়া হয়নি। সকাল থেকে এ পর্যন্ত চা খাওয়া হয়েছে সাত কাপ। সমুচা দুটি। তিনটি নোতা বিস্কিট। এক গ্লাস লাচ্ছি। এখন ক্ষিধে জানান দিচ্ছে। কিন্তু এ সময়ে হোটেলে উচ্ছিষ্ট খাবার ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। ভাত হয় কড়কড়া। বেয়ারাগুলি ঝিমায়। তিনবার ডাকলে তবেই
সাড়া দেয়। অসময়ের কাস্টমারদের প্রতি এদের কোনো মমতা নেই।
সোবাহান মাঝারি সাইজের একটা হোটেলে ঢুকে পড়ল। এক প্লেট ভাত আর ডাল-গোশতের অর্ডার দিয়ে বসে রইল। ভাতের প্লেট নামিয়ে বয়টি দাঁত বের করে বলল, ডাল-গোশত নাই, ইলিশ মাছ আছে। আনুম?
বয়টির ডান হাতে একটা ফেঁড়া। সাদা হয়ে পেকে আছে। সোবাহানের ক্ষিধে মরে গেল।
কি, খাইবেন না?
না।
কোথায় খাওয়া যায়? খাওয়ার কি কোনো জায়গা আছে? সোবাহানের বমি বমি ভাব হলো। ভাতের থালাটির পাশে পেকে ওঠা ফোড়ার ছবিটি উঠে আসছে। কিছু কিছু ছবি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হতে থাকে। সে বাসে চাপা পড়া একটা কুকুর দেখেছিল। একবার। মাথাটা থেতলে মিশে গেছে। চোখ বেরিয়ে এসেছে কোটর থেকে। সোবাহানের মনে হয়েছিল চোখ দুটি এখনো সবকিছু দেখছে। অবাক হয়ে জগতের নিষ্ঠুরতা দেখছে।