আবদুল জাব্বার এই কথা বলিয়া বামহস্তে একখানি দর্পণ লইয়া স্ত্রীর মুখের কাছে ধরিলেন। জয়নাব তৎপ্রতি ল্য না করিয়া দর্পণখানি গ্রহণপূর্বক উপবেশনস্থানের এক পার্শ্বে রাখিয়া দিলেন। গম্ভীর বদনে বলিলেন, “স্ত্রীলোকের কার্য কী?”
আবদুল জাব্বার বলিলেন, “তাহা আমি জানি। আমার অবস্থা ভাল হইলে আমি অসংখ্য দাস-দাসী রাখিয়া দিতাম; তাহারাই সকল কার্য করিত। তোমাকে এত পরিশ্রম, এত কষ্ট কখনোই সহ্য করিতে হইত না।”
জয়নাব বলিলেন, “আপনি যাহাই বলুন, আমি তাহাতে সুখী হইতাম না। আপনি বোধ হয় স্থির করিয়াছেন যে, যাহাদের অনেক দাস-দাসী আছে, মণিমুক্তার অলঙ্কার আছে, বহুমূল্য বস্ত্রাদি আছে, তাহারাই জগতে সুখী; তাহা মনে করিবেন না, মনের সুখই যথার্থ সুখ।”
আবদুল জাব্বার বলিলেন, “ও কোন কথাই নহে। টাকা থাকিলে সুখের অভাব কী? আমি এজিদের ন্যায় ঐশ্বর্যশালী হইতাম, তোমাকে কত সুখে রাখিতাম, তাহা আমি জানি, আর আমার মনই জানে। ঈশ্বর টাকা দেন নাই, কী করিব, মনের সাধ মনেই রহিয়া গেল।”
গম্ভীরবদনে জয়নাব কহিলেন, “ও-কথা বলিবেন না। শাহজাদা এজিদের ন্যায় আপনি ক্ষমতাবান্ বা ধনবান্ হইলে আমার ন্যায় কুশ্রী স্ত্রীর প্রতি আপনার ভালবাসা জন্মিত না। আপনারই নয়ন আমাকে দেখিয়া ঘৃণা করিত। ঈশ্বরের সৃষ্টি অতি বিচিত্র! কাহাকেও তিনি সীমাবিশিষ্ট করিয়া রূপবতী করেন নাই। উচ্চাসনে বসিলে আপনার মন সেইরূপ উচ্চরূপেই মোহিত হইত। অবস্থার পরিবর্তনে মানুষের মনের পরীক্ষা হয়।”
“অবস্থার পরিবর্তন হইলেই কি প্রণয়, মমতা, ভদ্রতা ও সুহৃদ ভাবের পরিবর্তন হয়?”
“হীন অবস্থার পরিবর্তনে অবশ্যই কিছু পরিবর্তন হয়,-কিছু কেন? প্রায়ই পরিবর্তন হইয়া থাকে। চারিদিকে চাহিলেই অনেক দেখিতে পাইবেন। যাহারা ধনপিপাসু, অর্থকেই যাহারা ইহকাল-পরকালের সুখসাধন মনে করে, তাহারা অর্থলোভে অতি জঘন্য কার্য করিতে একটুও চিন্তা করে না, তাহারা অতি আদরের ও যত্নের ভালবাসা জিনিসটিও অর্থলোভে বিসর্জন দিতে কিছুমাত্র অপেক্ষা করে না।”
কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ন হইয়া আবদুল জাব্বার কহিলেন, “এ-কথাটা একপ্রকার আমাতেই বর্তিল। তুমি যাহাই বল, জগতের সমুদয় অর্থ, সমুদয় ঐশ্বর্য একত্র করিয়া আমার সম্মুখে রাখিলেও আমি আমার ভালবাসাকে পরিত্যাগ করিতে পারি না। সকলেরই মূল্য আছে, ভালবাসার মূল্য নাই। যখন মূল্য নাই, তখন আর তাহার সঙ্গে অন্য বস্তুর তুলনা কি, কথাই-বা কি?”
আবদুল জাব্বারের আহার শেষ হইল। রীতিমত হস্তমুখাদি প্রক্ষালন করিয়া ব্যবসায়ের হিসাবপত্রাদি লইতে তিনি ব্যতিব্যস্ত হইলেন। যেখানে যাহা রাখিয়াছেন, একে একে সংগ্রহ করিলেন। ব্যবসায়ের সাহায্যকারী অথচ নিকট-আত্মীয় ওস্মানের নাম করিয়া মনে মনে বলিতে লাগিলেন, “এখনো আসিল না। আজ অনেক অসুবিধা হইবে। আর কতক্ষণ বিলম্ব করিব?” এই কথা বলিয়াই বাটী হইতে যাত্রা করিলেন, এমন সময়ে ওস্মান অতি ব্যস্তভাবে আসিয়া বলিলেন, “আবদুল জাব্বার! দামেস্ক হইতে একজন কাসেদ্ আসিয়াছে-অত্যন্ত ব্যস্ত, অতিশয় পরিশ্রান্ত, অতিশয় ক্লান্ত। সেই লোক তোমাকেই অন্বেষণ করে। তোমার বাসস্থানের অনুসন্ধান না পাইয়া অনেক ঘুরিয়াছে। শুনিলাম, তাহার নিকট দামেস্কাধিপতির আদেশপত্র আছে।”
ওস্মানের মুখে এই কথা শুনিয়া আবদুল জাব্বার শশব্যস্তে বাটীর বাহিরে আসিলেন। কাসেদ্ ঈশ্বরের গুণানুবাদ করিয়া দামেস্কাধিপতির বন্দনার পর অতি বিনীতভাবে আবদুল জাব্বারের হস্তে শাহীনামা প্রদান করিলেন।
আবদুল জাব্বার শত শত বার সেই শাহীনামা চুম্বন ও মস্তকোপরি ধারণ করিয়া কাসেদের যথাযোগ্য অভ্যর্থনা করিলেন। অনন্তর শাহীনামাহস্তেই অন্তঃপুরমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। তথায় উপস্থিত হইয়া বিশেষ ভক্তিসহকারে শাহীনামাখানি পাঠ করিলেন। তাহাতে লিখিত আছে-
“সম্ভ্রান্ত আবদুল জাব্বার!
তোমাকে জানান যাইতেছে যে, দামেস্কাধিপতি তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে স্মরণ করিয়াছেন। অবিলম্বে রাজধানীতে উপস্থিত হইয়া রাজপ্রসাদলাভে সৌভাগ্য জ্ঞান কর।
প্রধান উজির-
মারওয়ান।”
আবদুল জাব্বার এতৎপাঠে মহাসৌভাগ্য জ্ঞান করিয়া জয়নাবকে কহিলেন, “আমি এখনই দামেস্কনগরে যাত্রা করিব। আমি এমন কী পুণ্য কার্য করিয়াছি যে, স্বয়ং বাদশাহ আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন। ঈশ্বর জানেন, ভবিষ্যতে কী আছে।”
আবদুল জাব্বারের এই সংবাদ শ্রবণে প্রতিবেশীরা সকলেই আশ্চর্যান্বিত হইলেন। আবদুল জাব্বারের মহাসৌভাগ্য! সকলেই শাহীনামা মহামান্যে মস্তকোপরি রাখিয়া দামেস্ক-সিংহাসনের গৌরব রক্ষা করিলেন। সকলেই একবাক্যে আবদুল জাব্বারের গুণানুবাদ করিয়া কহিলেন, “আবদুল জাব্বারের কপাল ফিরিল।” সমবয়সীরা বলিতে লাগিল, “ভাই! তুমি তো ভাগ্যগুণে বাদশাহের নিকট পরিচিত হইলে। সম্মানের সহিত রাজদরবারেও আহূত হইলে। আমাদের কথা মনে রাখিয়ো।”
আবদুল জাব্বার ব্যতিব্যস্ত হইয়া রাজধানী গমনের উদ্যোগী হইলেন। আত্মীয়-স্বজন এবং সাধারণ প্রতিবেশীগণের নিকট ও জয়নাবের সমক্ষে বিনয়নম্রভাবে বিদায় গ্রহণ করিলেন। শাহীদরবারে গমন-উপযোগী যে সকল বসন তাঁহার ছিল, তৎসমস্ত সংগ্রহ করিয়া বাহক-বাহন সমভিব্যাহারে দামেস্কনগরাভিমুখে গমনার্থ প্রস্তুত হইলেন। প্রতিবেশীবর্গ সহাস্য বদনে তাঁহার প্রশংসাগান কীর্তন করিতে করিতে স্ব স্ব আবাসে চলিয়া গেলেন। জয়নাবের চক্ষু দুটি বাষ্প-সলিলে পরিপূর্ণ হইল। মনের উল্লাসে আবদুল জাব্বার তৎকালে এতদূর বিহ্বল হইয়াছিলেন যে, যাত্রাকালে প্রিয়তমা জয়নাবকে একটিও মনের কথা বলিয়া যাইতে মনে হইল না। সামান্যতঃ বিদায় গ্রহণ করিয়াই ত্বরিতগতিতে রাজদর্শনে যাত্রা করিলেন। পদমর্যাদার এমনই কুহক!
মহরম পর্ব ০৩ প্রবাহ
এজিদের শিরায় শিরায়, শোণিতবিন্দুর প্রতি পরমাণু অংশে, প্রতি শ্বাস-প্রশ্বাসে, শয়নে-স্বপ্নে, জয়নাব লাভের চিন্তা অন্তরে অবিচলিতভাবে রহিয়াছে। কিন্তু সে চিন্তার উপরেও আর একটি চিন্তা শুদ্ধ মস্তিষ্ক মধ্যে ঘুরিতেছে। এক সময়ে এক মনে দুই প্রকারের চিন্তা অসম্ভব। কিন্তু মূল চিন্তার কৃতকার্যতা লাভের আশায় অন্য একটি চিন্তা বা কল্পনা আশ্রয় করিয়া কার্যেক্ষেত্রে অবতীর্ণ না হওয়া যায়, এরূপ নহে। প্রথম চিন্তায় কৃতকার্য হইবার আশাতেই বাহ্যিক চিন্তাই প্রবল হইয়া উঠে। চিন্তার আধার মস্তক; কিন্তু ভালবাসার চিন্তাটুকু মস্তকে উদিত হইয়াই একেবারে হৃদয়ের অন্তঃস্থান অধিকার করিয়া বসে। তাহা যখনই মনে উদয় হয়, অন্তরে ব্যথা লাগে, হৃৎপিণ্ডে আঘাত হয়। হৃদয়তন্ত্রী বেহাগ-রাগে বাজিয়া উঠে। এজিদ্ আপাততঃ বাহ্যচিন্তাতেই মহাব্যস্ত। কারণ এই চিন্তার মধ্যে আশা, ভরসা, নিরাশা, সকলই রহিয়াছে। কাজেই পূর্বভাবের কিঞ্চিৎ পরিবর্তন বোধ হইতেছে। এজিদের নয়নে, ললাটে ও মুখশ্রীতে যেন ভিন্ন ভাব সমঙ্কিত। দেখিলেই বোধহয় কোন দগ্ধীভূত বিকৃত ধাতুর উপরে কিঞ্চিৎ রজতের পাকা গিল্টী হইয়াছে। হঠাৎ দেখিলে চাক্চিক্যবিশিষ্ট রজতপাত্র বলিয়াই ভ্রম জন্মে। কিন্তু মনোনিবেশ করিয়া লক্ষ্য করিলে সমাবৃত বিকৃত ধাতুর পরমাণু অংশ নয়নগোচর হইয়া চাক্চিক্যবিশিষ্ট উজ্জ্বলভাবে যেন বহুদূরে সরিয়া যায়। পুরবাসিগণ এবং অমাত্যগণ সকলেই রাজপুত্রের তাদৃশ বাহ্যিক প্রসন্ন ভাব দর্শন করিয়া মহা আনন্দিত হইলেন।