রাজমহিষী অতি কষ্টে মস্তক উত্তোলন করিয়া কম্পিতকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “মহারাজ! আমি অনেক সন্ধানে জানিয়াছি, আর এজিদ্ও আপনার নিকটে আভাসে বলিয়াছে।-আবদুল জাব্বারকে বোধ হয় আপনি জানেন?”
মাবিয়া কহিলেন, “তাহাকে তো অনেক দিন হইতেই জানি।” “সেই আবদুল জাব্বারের স্ত্রীর নাম জয়নাব।”
“হাঁ হাঁ, ঠিক হইয়াছে। আমার সঙ্গে কথা কহিবার সময় ‘জয়’ পর্যন্ত বলিয়া আর বলিতে পারে নাই।” একটু অগ্রসর হইয়া মাবিয়া আবার কহিলেন, “হাঁ! সেই জয়নাব কি?”
“আমার মাথা আর মুণ্ডু! সেই জয়নাবকে দেখিয়াই তো এজিদ্ পাগল হইয়াছে। আমার নিকট কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলিতে লাগিল, মা, যদি আমি জয়নাবকে না পাই, তবে আর আমাকে দেখিতে পাইবেন না। নিশ্চয় জানাজা (মৃত শরীরের সদ্গতির উপাসনা) ক্ষেত্রে কাফনবস্ত্রের তাবুতাসনে ধরাশায়ী দেখিবেন।” এই পর্যন্ত বলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে মহিষী পুনর্বার কহিলেন, “আমার এজিদ্ যদি না বাঁচিল, তবে আর এই জীবনে ও বৃথা ধনে ফল কি?”
যেন একটু সরোষে মাবিয়া কহিলেন, “মহিষী! তুমি আমাকে কী করিতে বল?”
“আমি কি করিতে বলিব? যাহাতে এজিদের প্রাণরক্ষা হয় তাহারই উপায় করুন। আপনি বর্তমান থাকিতে আমার সাধ্যই-বা কী-কথাই-বা কী?”
মাবিয়া রোষভরে উঠিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন, বৃদ্ধা মহিষী হস্ত ধরিবামাত্র অমনি বসিয়া পড়িলেন। বলিতে লাগিলেন, “পাপী আর নারকীরা এ কার্যে যোগ দিবে। আমি ও-কথা আর শুনিতে চাই না। তুমি আর ও-কথা বলিয়া আমার কর্ণকে কলুষিত করিয়ো না। আপনার জিহ্বাকে ও পাপকথায় অপবিত্র করিয়ো না। ভাবিয়া দেখ দেখি, ধর্ম-পুস্তকের উপদেশ কি? পরস্ত্রীর প্রতি কুভাবে যে একবার দৃষ্টি করিবে, কোন প্রকার কুভাবের কথা মনোমধ্যে যে একবার উদিত করিবে, তাহারও প্রধান নরক ‘জাহান্নামে’ বাস হইবে। আর ইহকালের বিচার দেখিতে পাইতেছ! লৌহদণ্ড দ্বারা শত আঘাতে পরস্ত্রীহারীর অস্থি চূর্ণ, চর্ম ক্ষয় করিয়া জীবনান্ত করে। ইহা কী একবারও এজিদের মনে হয় না? প্রজার ধন, প্রাণ, মান, জাতি, এ সমুদয়ের রক্ষাকর্তা রাজা। রাজার কর্তব্যকর্মই তাহা। এই কর্তব্যে অবহেলা করিলে রাজাকে ঈশ্বরের নিকট দায়ী হইতে হয়। পরিণামে নরকের তেজোময় অগ্নিতে দগ্ধীভূত হইয়া ভস্মসাৎ হইতে হয়। তাহাতেও নিস্তার নাই। সে ভস্ম হইতে পুনরায় শরীর গঠিত হইয়া পুনরায় শাস্তিভোগ করিতে হয়। এমন গুরুপাপের অনুষ্ঠান করা দূরে থাকুক, শুনিতেও পাপ আছে। এজিদ্ আত্মবিনাশ করিতে চায়, করুক, তাহাতে দুঃখিত নহি। এমন শত এজিদ-শত কেন সহস্র এজিদ্ এই কারণে প্রাণত্যাগ করিলেও মাবিয়ার চক্ষে এক বিন্দু জল পড়া দূরে থাকুক বরং সন্তোষ-হৃদয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিবে। একটা পাপী জগৎ হইতে বহিষ্কৃত হইল বলিয়া ঈশ্বরের সমীপে এই মাবিয়া সেই জগৎপিতার নামে সহস্র সহস্র সাধুবাদ সমর্পণ করিবে। পুত্রের উপরোধে, কি তাহার প্রাণ রক্ষার কারণে ঈশ্বরের বাক্য-লঙ্ঘন করিয়া মাবিয়া কি মহাপাপী হইবে? তুমি কি তাহা মনে কর মহিষী? আমার প্রাণ থাকিতে তাহা হইবে না, মাবিয়া জগতে থাকিতে তাহা ঘটিবে না-কখনোই না।”
বৃদ্ধা মহিষী একটু অগ্রসর হইয়া মহারাজের হস্ত দৃঢ়রূপে ধারণ করিয়া কাতরভাবে বলিতে লাগিলেন, “দেখুন মহারাজ! এজিদ্ যে ফাঁদে পড়িয়াছে, সে ফাঁদে জগতের অনেক ভাল ভাল লোক বাঁধা পড়িয়াছেন। শত শত মুনি-ঋষি, ঈশ্বরভক্ত, কত শত মহাতেজস্বী জিতেন্দ্রিয় মহাশক্তিবিশিষ্ট মহাপুরুষ এই ফাঁদে পড়িয়া তত্ত্বজ্ঞান হারাইয়াছেন, তাহার সংখ্যা নাই। আসক্তি, প্রেম ও ভালবাসার কথা ধর্মপুস্তকেও রহিয়াছে। ভাবিয়া দেখিলে প্রতীত হয়, মানুষের মধ্যেই ভালবাসার জন্ম, ইহা কাহাকেও শিক্ষা দিতে হয় না, দেখিয়াও কেহ শিক্ষা করে না, ভালবাসা স্বভাবতঃই জন্মে। বাদশানাম্দার! ইহাতে নূতন কিছুই নাই, আপনি যদি মনোযোগ করিয়া শুনেন, তবে আমি প্রণয় প্রসঙ্গ অনেক শুনাইতে পারি, দৃষ্টান্ত দ্বারা দেখাইতেও পারি। জগতে শত শত ভালবাসার জন্ম হইয়াছে, অনেকেই ভালবাসিয়াছে, তাহাদের কীর্তিকলাপ আজ পর্যন্ত-আজ পর্যন্ত কেন, জগৎ বিলয় না হওয়া পর্যন্ত মানবহৃদয়ে সমভাবে অঙ্কিত থাকিবে। বলিবেন, পাত্র বিবেচনা চাই। ভালবাসারূপ সমুদ্র যখন হৃদয়াকাশে মানস-চন্দ্রের আকর্ষণে স্ফীত হইয়া উঠে, তখন পাত্রাপাত্র জ্ঞান থাকে না। পিতা, মাতা, সংসার, ধর্ম, এমন কি ঈশ্বরকেও মনে থাকে কি না সন্দেহ। ইহাতে এজিদের দোষ কি বলুন দেখি? এই নৈসর্গিক কার্য নিবারণ করিতে এজিদের কি ক্ষমতা আছে? না আমার ক্ষমতা আছে? না আপনারই ক্ষমতা আছে? যাহাই বলুন মহারাজ! ভালবাসার ক্ষমতা অসীম!”
মাবিয়া বলিলেন, “আমি কি ভালবাসার দোষ দিতেছি? ভালবাসা তো ভাল কথা। মানব-শরীর ধারণ করিয়া যাহার হৃদয়ে ভালবাসা নাই, সে কি মানুষ? প্রেমশূন্য-হৃদয় কি হৃদয়? এজিদের ভালবাসা তো সেরূপ ভালবাসা নয়! তুমি কি কিছুই বুঝিতে পার নাই?”
মহিষী কহিলেন, “আমি বুঝিয়াছি, আপনিই বুঝিতে পারেন নাই। দেখুন মহারাজ! আমার এই অবস্থাতে ঈশ্বর সদয় হইয়া পুত্র দিয়াছেন। এ জগতে সংসারী মাত্রেই পুত্র কামনা করিয়া থাকে। বিষয়বিভব, ধন-সম্পত্তি অনেকেরই আছে; কিন্তু উপযুক্ত পুত্ররত্ন কাহার ভাগ্যে কয়টি ফলে বলুন দেখি? পুত্র-কামনায় লোকে কী না করে? ঈশ্বরের উপাসনা, ঈশ্বরভক্ত এবং ঈশ্বরপ্রেমিক লোকের অনুগ্রহের প্রত্যাশা, যথাসাধ্য দীন-দুঃখীর ভরণপোষণের সাহায্য প্রভৃতি যত প্রকার সৎকার্যে মনে আনন্দ জন্মে, সন্তান-কামনায় লোকে তাহা সকলই করিয়া থাকে। আপনি ঈশ্বরের নিকট কামনা করিয়া পুত্রধন লাভ করেন নাই; আমিও পুত্রলাভের জন্য বৃদ্ধ বয়সে ব বিদীর্ণ করিয়া শোণিতবিন্দু ঈশ্বরের উদ্দেশে উৎসর্গ করি নাই। দয়াময় ভগবানের প্রসাদে, অযাচিতভাবে এবং বিনাযত্নে আমরা উভয়ে এ পুত্ররত্ন লাভ করিয়াছি। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করিয়া ক্রোধ করিতে হয়। যে এজিদের মুখ, এক মুহূর্ত না দেখিলে একেবারে জ্ঞানশূন্য হন, এজিদ্কে সর্বদা নিকটে রাখিয়াও আপনার দেখিবার সাধ মিটে না, আমি তো সকলই জানি, কোন সময়ে এই এজিদ্কে প্রাণে মারিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন, তাহা পারিলেন কই? ঐ মুখ দেখিয়াই তো হাতের অস্ত্র হাতেই রহিয়াছিল। অস্ত্রাঘাতে পুত্রের প্রাণবধ-সঙ্কল্প সাধন করিবেন দূরে থাকুক, ক্রোড়ে লইয়া শত শতবার মুখচুম্বন করিয়াও মনের সাধ মিটাইতে পারেন নাই।”