মোহাম্মদ হানিফা রোষে অধীর হইয়া, “যাবি কোথা, নরাধম।” এই কথা বলিয়া বীর-বিক্রমে হুঙ্কার ছাড়িয়া অসি হস্তে কূপমধ্যে লম্ফ দিবার উপক্রমেই বজ্রনাদে শব্দ হইল, “হানিফা! এজিদ্ তোমার বধ্য নহে।”
মোহাম্মদ হানিফা থতমত খাইয়া ঊর্ধ্বদিকে চাহিতেই প্রভু হোসেনের তেজোময় ছায়া দেখিয়া চমকিয়া পিছে হটিলেন এবং ভয়ে চক্ষু বন্ধ করিলেন।
পুনরায় গভীর নিনাদে শব্দ হইল, “হানিফা ক্ষান্ত হও, এজিদ্ তোমার বধ্য নহে।”
মোহাম্মদ হানিফা পুনরায় চক্ষু মেলিয়া তাকাতেই দেখিলেন, মহা অগ্নিময় মহাতেজ অসংখ্য শিখা বিস্তারে সহস্র অশনিপাত সদৃশ বিকট শব্দ করিয়া নিকু মধ্যস্থ কূপমধ্যে মহাবেগে প্রবেশ করিল। এজিদের আর্তনাদে উদ্যানস্থ পক্ষিকুল বিকট কণ্ঠে ভয়ে ডাকিয়া উঠিল, বাসা ছাড়িয়া, শাখা ছাড়িয়া, দিগ্বিদিকে উড়িয়া বেড়াইতে আরম্ভ করিল। ভূকম্পনে তরুলতা সকল ভয়ে কাঁপিতে লাগিল। গাজী রহমান, মসহাব কাক্কা, ওমর আলী, আক্কেল আলী প্রভৃতি উপস্থিত ঘটনা দেখিয়া নির্বাকে হানিফার পশ্চাতে দণ্ডায়মান রহিল। মোহাম্মদ হানিফার ভাব ভিন্ন। মুখাকৃতি বিকৃত অথচ হিংসায় পরিপূর্ণ। হৃদয় হিংসানলে দগ্ধীভূত। স্থিরনেত্রে ঊর্ধ্বমুখ হইয়া দণ্ডায়মান। তরবারি-মুষ্টি দক্ষিণ হস্তে, অগ্রভাগ বামস্কন্ধে স্থাপিত।
আবার দৈববাণী, “হানিফা! দুঃখ করিয়ো না। এজিদ্ কাহারো বধ্য নহে। রোজ কেয়ামত (শেষ দিন) পর্যন্ত এজিদ্ এই কূপে-এই জ্বলন্ত হুতাশনে জ্বলিতে থাকিবে, পুড়িতে থাকিবে, অথচ প্রাণ বিয়োগ হইবে না।”
মোহাম্মদ হানিফা চমকিয়া উঠিলেন। তরবারির অগ্রভাগ স্কন্ধ হইতে মৃত্তিকা স্পর্শ করিল। অশ্ব বল্গা বামহস্তে ধরিয়া বলিতে লাগিলেন, “এজিদ্ আমার বধ্য নহে। আর কি করিব? ইচ্ছা করিলে এক তীব্র তীরে নরাধমের কলিজা পার করিতে পারিতাম; হৃদয়ের রক্তধারে তরবারির দ্বারাই নারকীয় দেহ দুই খণ্ডে বিভক্ত হইত। তাহা করি নাই। চক্ষে চক্ষে সম্মুখে সম্মুখে না যুঝিয়া, অস্ত্রের চাক্চিক্য না দেখাইয়া কাহারো প্রাণসংহার করি নাই। ইহজীবনে কাহারো পৃষ্ঠে আঘাত করি নাই। এজিদ্ পৃষ্ঠ দেখাইল। আর অস্ত্রের আঘাত কি? জীবন্ত ধরিব, সকলের সম্মুখে ধরিয়া আনিব, একত্র একসঙ্গে মনের আগুন নির্বাণ করিব, তাহা হইল না। মনের আশা মিটিল না। এত পরিশ্রম করিয়াও কৃতকার্য হইতে পারিলাম না। এখন কি করিব? প্রিয় গাজী রহমান! ভাই মস্হাব! হানিফার মনের আগুন নিবিল না। আশা পূর্ণ হইল না! কী করি?”
এই বলিয়া মোহাম্মদ হানিফা পুনরায় অশ্বে আরোহণ করিলেন,-চক্ষের পলকে উদ্যান হইতে বাহির হইলেন। গাজী রহমান মহাসঙ্কটকাল ভাবিয়া মসহাব কাক্কা, ওমর আলী প্রভৃতিকে বলিলেন-“ভাবিয়াছিলাম, আজই বিষাদের শেষ। ভাবিয়াছিলাম, আজই বিষাদ-সিন্ধু পার হইয়া সুখ-সিন্ধুর সুখতটে সকলে একত্র উঠিব, বোধ হয় তাহা ঘটিল না। শীঘ্র আসুন! বিলম্ব করিবেন না, আমি ভবিষ্যৎ বড়ই অমঙ্গল দেখিতেছি, আম্বাজাধিপতির মতি গতি ভাল বোধ হইতেছে না। শীঘ্র অশ্বে আরোহণ করুন। বড়ই কঠিন সময় উপস্থিত, দয়াময়ের লীলা বুঝিয়া উঠা মানুষের সাধ্য নহে।”
এজিদ-বধ পর্ব ০৫ প্রবাহ
এখন আর সূর্য নাই। পশ্চিম গগনে মাত্র লোহিত আভা আছে। সন্ধ্যাদেবী ঘোমটা খুলিয়াছেন, কিন্তু সম্পূর্ণ নহে। তারাদল দলে দলে দেখা দিতে অগ্রসর হইতেছেন, কেহ কেহ সন্ধ্যা-সীমন্তিনীর সীমন্ত উপরিস্থ অম্বরে ঝুলিয়া জগৎ মোহিত করিতেছেন, কেহ বা সুদূরে থাকিয়া মিটিমিটিভাবে চাহিতেছেন; ঘৃণার সহিত চক্ষু বন্ধ করিতেছেন আবার দেখিতেছেন। মানবদেহের সহিত তারাদলের সম্বন্ধ নাই বলিয়াই দেখিতে পারিতেছেন না। কিন্তু বহুদূরে থাকিয়াও চক্ষু বন্ধ করিতে হইতেছে-কে দেখিতে পারে? অন্যায় নরহত্যা, অবৈধ বধ, কোন্ চক্ষু দেখিতে পারে? আজ কাল সূর্যের উদয় না হইতেই হানিফার রোষের উদয়, তরবারি ধারণ। সে সূর্য অস্তমিত হইল, দামেস্কপ্রান্তরে মরুভূমিতে রক্তের স্রোত বহিল, কিন্তু মোহাম্মদ হানিফার জিঘাংসা-বৃত্তি নিবৃত্ত হইল না। “এজিদ্ তোমার বধ্য নহে” দৈববাণীতে মোহাম্মদ হানিফার অন্তরে রোষ এবং ভয় একত্র এক সময়ে উদয় হইয়াছে। উদ্যানমধ্যে ঊর্ধ্বমুখ হইয়া স্থিরনেত্রে ক্ষণকাল চিন্তার কারণও তাহাই। এক সময়ে দুই ভাব, পরস্পর বিপরীত ভাব-নিতান্তই অসম্ভব; কিন্তু হইয়াছে তাহাই-ভয় এবং রোষ। বীরহৃদয় ভয়ে ভীত হইবার নহে। তবে যে কিঞ্চিৎ কাঁপিতেছিল, তাহা-দৈববাণী বলিয়া, প্রভু হোসেনের জ্যোতির্ময় পবিত্র ছায়া দেখিয়া। কিন্তু পরিশেষে নির্ভয়হৃদয়ে ভয়ের স্থান হইল না। সুতরাং রোষেরই জয়। প্রমাণ-অশ্বে আরোহণ, সজোরে কশাঘাত।
কানন-দ্বার পার হইয়া এজিদের গুপ্তপুরী-প্রবেশদ্বার আবরণকারী লতাপাতাবেষ্টিত নিকু প্রতি একবার চক্ষু ফিরাইয়া দেখিলেন, দুর্গন্ধময় ধূমরাশি হু-হু করিয়া আকাশে উঠিতেছে, বাতাসে মিশিতেছে। রাজপুরী পশ্চাতে রাখিয়া দামেস্ক নগরের পথে চলিলেন। যে তাঁহার সম্মুখে পড়িতে লাগিল, তাহারই জীবন শেষ হইল। বিনা অপরাধে হানিফার অস্ত্রে জীবনলীলা সাঙ্গ করিয়া খণ্ডিত দেহ ধুলায় গড়াগড়ি যাইতে লাগিল। জয়নালভক্ত প্রজাগণ এজিদের পরিণাম-দশা দেখিতে আনন্দোৎসাহে রাজপুরীর দিকে দলে দলে আসিতেছিল। হানিফার রোষাগ্নিতে পড়িয়া এক পদও অগ্রসর হইতে পারিল না, আপন প্রতিপালক রক্ষক-হস্তে প্রাণ বিসর্জন করিতে লাগিল।