অশ্বারোহী যদি বাগডোরে জোর না রাখে, ঘোড়ার ইচ্ছানুযায়ী গতিতে যদি বাধা না দেয় তবে অশ্বমাত্রই আপন বাসস্থানে ছুটিয়া আসিতে চেষ্টা করে। এজিদ্ নিরাশ হইয়া হস্তস্থিত অশ্ববল্গা ছাড়িয়া দিয়াছে। কোথায় যাইবে কি করিবে, কোন্ পথে কোথায় গেলে পশ্চাদ্ধাবিত যমের হস্ত হইতে রক্ষা পাইবে, স্থির করিতে না পারিয়াই তুরঙ্গ-গতিস্রোতে অঙ্গ ভাসাইয়া দিয়াছে। রাজ অশ্ব রাজধানী অভিমুখেই ছুটিয়াছে। দামেস্ক এজিদের রাজ্য। পথ ঘাট সকলই পরিচিত, রাজধানী অভিমুখে অশ্বের গতি দেখিয়া, তাহার নিরাশ হৃদয়ে নূতন একটি আশার সঞ্চার হইল-রাজপুরীমধ্যে যাইতে পারিলেই রক্ষা। মনের ব্যগ্রতায় এবং প্রাণের মায়ায় আকুল হইয়া দুই হস্তে অশ্বে কশাঘাত করিতে লাগিল। রাজপুরী-মধ্যে প্রবেশ করিতে পারিলেই যেন প্রাণ বাঁচাইতে পারে। যুগল অশ্ব বেগে দৌড়িতে থাকুক, এই অবসরে এজিদের নূতন কথাটা ভাঙ্গিয়া বলি।
হজরত মাবিয়ার লোকান্তর গমনের পর, এজিদ্ মারওয়ানের মন্ত্রণায় দামেস্কপুরী সংলগ্ন উদ্যান মধ্যে, ভূগর্ভে এক সুন্দর পুরী নির্মাণ করিয়াছিল। এ গুপ্তপুরীর প্রবেশদ্বারও এমন সুন্দর কৌশলে নির্মিত হইয়াছিল যে, উদ্যানালঙ্কার নিকু ভিন্ন, দ্বার বলিয়া কেহই নির্ধারণ করিতে পারিত না। যে সময়ের অপেক্ষায় ঐ পুরী আজ সেই সময় উপস্থিত। এজিদের প্রিয় পরিজন, আত্মীয়-স্বজন প্রাণভয়ে সকলেই ঐ গুপ্তপুরীর মধ্যে আশ্রয় লইয়াছে। তাহার প্রমাণও পূর্বে পাওয়া গিয়াছে। যেখানকার যে জিনিস সেইখানেই পড়িয়া আছে, জনপ্রাণী মাত্র নাই। কোথায় যাইবে, শত্রু-সেনাপরিবেষ্টিত পুরীমধ্য হইতে কোথায় পলাইবে? ঐ গুপ্তপুরীই প্রাণরক্ষার উপযুক্ত স্থান। এজিদের মনে সেই আশা। সে নীরস হৃদয়ক্ষেত্রে এ একমাত্র আশা-বীজের নব অঙ্কুর। পুরীর কথা মনে পড়িতেই পরিবার-পরিজনের কথা মনে হইয়াছে। কিঞ্চিৎ আশ্বস্তও হইয়াছে। রাজপুরী পরহস্তগত হইলেও পরিবার-পরিজন কখনোই পরহস্তগত হইবে না। দামেস্কপুরী তন্নতন্ন করিলেও তাহাদের বিষাদিত কায়া চক্ষে পড়া দূরে থাকুক, ছায়া পর্যন্ত নজরে আসিবে না। এখন উদ্যান পর্যন্ত যাইতে পারিলেই আর পায় কে? লতা-পুষ্প-ছড়িত কু পর্যন্ত যাইতে পারিলেই হানিফা দেখিবেন যে, এজিদ্ লতাপাতায় মিশিয়া গেল, পরমাণু আকারে পুষ্প-রেণু সহিত মিশিয়া পুষ্প-দলে ঢাকিয়া ফেলিল। যাহাই হউক, উদ্যান পর্যন্ত যাইতে পারিলেই এজিদের জয়। নগরও নিকটবর্তী, এজিদ্ জন্মের মত দামেস্ক নগরের পতন দৃশ্য দেখিয়া চলিল। দেখিতে দেখিতে নগরের সুরঞ্জিত সিংহদ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইল। দ্বার অবারিত, প্রহরী বর্জিত! মৃতদেহে রাজপথ পরিপূর্ণ। শবাহারী পশুপক্ষিগণ মহা আনন্দিত। চক্ষের পলকে দ্বার পার হইয়া নগরে প্রবেশ করিল। রাজপুরী চক্ষে পড়িতেই দেখিল, উচ্চ উচ্চ মঞ্চে নানা আকারে নূতন পতাকাসকল নগরস্থ লোহিত আভায় মিশিয়া অর্ধচন্দ্র এবং পূর্ণতারা প্রত্যক্ষভাবে দেখাইয়া দামেস্কের পতন-দৃশ্য দর্শকগণকে দেখাইতেছে, বিজয়-বাজনা তুমুল বেগে কর্ণে আসিতেছে। ক্রমেই নিকটবর্তী, রাজপুরী অতি নিকটে। বন্দিগৃহ দূর হইলেও দৃষ্টির অদূর নহে। চক্ষে পড়িল। এজিদের চক্ষে দামেস্কের বন্দিগৃহ পড়িতেই মন যেন কেমন করিয়া চমকিয়া উঠিল। এমন সঙ্কট সময়েও এজিদের মন যেন কেমন করিয়া উঠিল। যে রূপ হৃদয়ের নিভৃত স্থানে লুকাইয়া ছিল, সরিয়া আসিল। কিন্তু বেশিক্ষণ রহিল না। চিত্তক্ষেত্র হইতে সে রূপরাশি একেবারে সরিয়া গেল। নামটি মনে উঠিল, মুখে ফুটিল না, দীর্ঘ-নিশ্বাসও বহিল না। প্রমাণ হইল-প্রমদা অপেক্ষা প্রাণের দায়ই সমধিক প্রবল। এই সামান্য অন্যমনস্কতায় অশ্বগতি কিঞ্চিৎ শিথিল হইল।
মোহাম্মদ হানিফা এই অবসরে ঐ পরিমাণ অগ্রসর হইয়া গভীর-গর্জনে বলিতে লাগিলেন, “এজিদ্ মনে করিয়াছ যে, পুরীমধ্যে প্রবেশ করিলেই আজিকার মত বাঁচিয়া যাইবে। তাহা কখনোই মনে করিও না। এই সন্ধ্যা-প্রদীপ জ্বলিতে জ্বলিতে তোমার জীবন-প্রদীপ নির্বাণ হইবে। তোমার পক্ষে দামেস্ক-রাজপুরী এইক্ষণ সাক্ষাৎ যমপুরী। কি কি আশায় সে দিকে দৌড়িয়াছ? দেখিতেছ না? উচ্চ মঞ্চে কাহার নিশান উড়িতেছে, দেখিতেছ না? রে নরাধম! তুই সেই এজিদ্ যে আরবে সর্বপ্রধান বীর হাসানকে কৌশল করিয়া মারিয়াছিস্! ওরে! তুই কি সেই পামর, যে সীমার দ্বারা হোসেনের মস্তক কাটাইয়া লক্ষ টাকা পুরস্কার দিয়াছিলি?”
মোহাম্মদ হানিফা ক্রোধে অধীর হইয়া অশ্বে কশাঘাত করিলেন। দ্রুতগতি অশ্বপদ শব্দে পুরজনগণ চমকিয়া উঠিলেন। বিজয় বাজনা, আনন্দ রোল, জয়রবের কোলাহল ভেদ করিয়া, অশ্ব-শব্দ মহাশব্দে সকলের কর্ণে প্রবেশ করিল। যিনি যে অবস্থায় ছিলেন, শশব্যস্ত হইয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে সিংহদ্বার দিকে ছুটিলেন। এজিদ্ অশ্ব হইতে প্রথমে উদ্যান, শেষে পুষ্পলতাসজ্জিত নিকু দেখিয়া একটু আশ্বস্ত হইল।
মস্হাব কাক্কা প্রভৃতি মহারথিগণ, কেহ অশ্বে কেহ পদব্রজে দ্রুতপদে অসি-হস্তে আসিতেই হানিফা উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, “ভ্রাতৃগণ! ক্ষান্ত হও! দোহাই তোমাদের ঈশ্বরের-ক্ষান্ত হও। এজিদ্ তোমাদের বধ্য নহে। বাধা দিয়ো না। এজিদের গমনে বাধা দিয়ো না। এজিদের প্রতি অস্ত্র-নিক্ষেপ করিয়ো না।”
মোহাম্মদ হানিফার কথা শেষ হইতে-না-হইতেই, এজিদ্ একলম্ফে অশ্ব হইতে নামিয়া উদ্যান অভিমুখে চলিল। হানিফাও ত্রস্তভাবে দুল্দুলের পৃষ্ঠ হইতে অবতরণ করিয়া অসিহস্তে এজিদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়িলেন! এজিদ্ যথাসাধ্য দৌড়িয়া উদ্যানস্থ নির্দিষ্ট নিকুঞ্জ মধ্যে যাইয়া ফিরিয়া তাকাইতেই দেখিলেন, মোহাম্মদ হানিফাও অতি নিকটে। বিকৃত এবং ভগ্নস্বরে বলিল, “হানিফা ক্ষান্ত হও। আর কেন? তোমার আশা তোমার প্রতিজ্ঞা, তোমার মুখেই রহিল, এজিদ্ চলিল।” এই কথা বলিয়াই এজিদ্ গুপ্তপুরী প্রবেশদ্বার-কূপ-মধ্যে প্রবেশ করিল।