যাহাই হউক ঈশ্বর কৃপায় পাপাত্মার মনে যাহাই উদয় হউক, সে সময় রক্ষা পাইলাম কিন্তু বন্দিখানায় আসিতে হইল। এই সেই বন্দিগৃহ। জয়নাব এজিদের বন্দিখানায় বন্দিনী। প্রভু-পরিজন এজিদের বন্দিখানায় এই হতভাগিনীর সঙ্গিনী! আমার কি আর উদ্ধার আছে? আমার পাপের কি ইতি আছে?-না আমার উদ্ধার আছে?
“দয়াময়! তুমিই অবলার আশ্রয়, তুমিই নিরাশ্রয়ের উভয় কালের আশ্রয়। করুণাময়! তোমাকেই সর্বসার মনে করিয়া এই রাজসিংহাসন পদতলে দলিত করিয়াছি, রাজভোগ, পাটরাণীর সুখ-সম্ভোগ ঘৃণার চক্ষে তুচ্ছ করিয়াছি, তুমিই বল, তুমিই সম্বল। তুমিই অনন্তকালের সহায়।”
পাঠক; ঐ শুনুন! ডঙ্কা তুরী ভেরীর বাদ্য শুনিতেছেন। জয়ধ্বনির দিকে মন দিয়াছেন।
“জয় জয়নাল আবেদীন!” শুনিলেন? দামেস্কের নবীন মহারাজ পরিবার পরিজনকে উদ্ধার করিতে আসিতেছেন। পূজনীয়া জননী, মাননীয়া সহোদরা এবং অপর গুরুজনকে বন্দিখানা হইতে উদ্ধার করিতে আসিতেছেন। বেশি দূর নয়, প্রায় বন্দিখানার নিকটে। কিন্তু জয়নাবের কথা এখনও শেষ হয় নাই। আবার শুনুন; এদিকে মহারাজও আসিতে থাকুন।
জয়নাব বলিতেছেন, আমার জন্যই প্রভু পরিবারের এই দুর্দশা। এজিদের প্রস্তাবে সম্মত হইলে; মদিনার সিংহাসন কখনোই শূন্য হইত না। জায়েদার হস্তে মহাবিষ উঠিত না। সখিনাও সদ্য বৈধব্য-যন্ত্রণা ভোগ করিত না। পবিত্র মস্তকও বর্শাগ্রে বিদ্ধ হইয়া সীমার-হস্তে দামেস্কে আসিত না। মহাভক্ত আজরও স্বহস্তে তিনি পুত্রের বধ সাধন করিতেন না। কত চক্ষে দেখিয়াছি, কত কানে শুনিয়াছি, হায়! হায়! সকল অনিষ্টের, সকল দুঃখের মূলই হতভাগিনী। শুনিয়াছি সীমারের প্রাণ, মদিনাপ্রান্তরে সপ্ত বীরের তীরের অগ্রভাগে গিয়াছে। আম্বাজ-অধিপতি মোহাম্মদ হানিফা দামেস্ক নগরের প্রান্ত সীমায় সসৈন্যে মহাবীর নরপতিগণ সহ আসিয়া এজিদের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ করিয়াছেন। তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ হইয়াছে। আমাদের উদ্ধারের জন্য মোহাম্মদ হানিফা এবং তাঁহার অন্যান্য ভ্রাতাগণ প্রাণপণে যুদ্ধ করিতেছেন। এজিদও স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত। কত কথাই শুনিলাম, শেষে শুনিলাম ওমর আলীর প্রাণবধের সংবাদ। শূলদণ্ড এজিদ শিবির সম্মুখে খাড়া হইয়াছে। কত লোক ওমর আলীর প্রাণবধ দেখিতে দৌড়িয়াছে। কারবালার যুদ্ধ সংবাদও শিবিরে থাকিয়া শুনিয়াছিলাম, দামেস্ক প্রান্তরে যুদ্ধ সংবাদ এজিদের বন্দিখানায় থাকিয়া শুনিতেছি। কারবালায় যথাসর্বস্ব হারাইলাম। এখানে হারাইলাম ইমাম বংশের একমাত্র ভরসা জয়নাল আবেদীন। এ কী শুনি “জয় জয়নাল আবেদীন” এ কিরূপ, কিরূপ ঘোষণা। ঐ তো আবার শুনিতেছি “জয় নবভূপতির জয়।” সে কী! কি কথা, আমি কি পাগল হইলাম! কি কথার পরিবর্তে কি কথা শুনিতেছি। ভেরী বাজাইয়া স্পষ্ট জয় ঘোষণা করিতেছে। এই তো একেবারে বন্দিখানার বহির্দ্বারে। এই কথা বলিয়াই জয়নাব সাহারবানু হাসনেবানুর কক্ষে যাইতে অতি ব্যস্তভাবে উঠিলেন। জয়নাবের মনের কথা আর ব্যক্ত হইল না। উচ্চৈঃস্বরে জয়রব করিতে করিতে সৈন্যগণ বন্দিখানার মধ্যে আসিয়া পড়িল! দীন মোহাম্মদী নিশান জয়ডঙ্কার তালে তালে দুলিয়া দুলিয়া উড়িতে লাগিল। নবীন মহারাজ আপন ঘনিষ্ট আত্মীয়-স্বজনসহ বন্দিগৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন।
পাঠক! এই অবসরে লেখকের একটি কথা শুনুন। সুখের কান্না পুরুষেও কাঁদে, স্ত্রীলোকেও কাঁদে। তবে পরিমাণে বেশি আর কম। জয়নাল আবেদীন বন্দিগৃহ মধ্যে প্রবেশ করিলে তাঁহার মাতা, সহোদরা প্রভৃতি প্রিয় পরিজনগণ সুখের কান্নায় চক্ষের জল ফেলিলেন, কি হাসিমুখে হাসিতে হাসিতে প্রিয়দর্শন জয়নালকে ক্রোড়ে করিয়া মুখচুম্বন করিলেন, কি কোন্ কথা কহিয়া প্রথমে কথা আরম্ভ করিলেন, তাহা নির্ণয় করা সহজ কথা নহে। দামেস্ক-কারাগার সৈন্য সামন্ত পরিবেষ্টিত হইলেও প্রত্যক্ষ দেখাইতে যে না পারি, তাহাও নহে। “কার সাধ্য রোধে কল্পনার আঁখি।” তবে কথা এই যে, তাহাই দেখিবেন, না মোহাম্মদ হানিফা এজিদের পশ্চাৎ ঘোড়া চালাইয়া কি করিতেছেন, তাহাই দেখিবেন? আমার বিবেচনায় শেষ দৃশ্যই এইক্ষণে প্রয়োজন। এজিদ্বধের জন্যই সকলে উৎসুক। গাজী রহমানেরও এ চিন্তাই এখন প্রবল! মোহাম্মদ হানিফার কি হইল? এজিদের ভাগ্যেই বা কি ঘটিল?
নবীন মহারাজ, তাঁহার মাতার পদধূলি মাথায় মাখিয়া অন্য অন্য গুরুজনের চরণ বন্দনা করিয়া বন্দিখানা হইতে বিজয় ডঙ্কা বাজাইতে বাজাইতে, জয়পতাকা উড়াইতে উড়াইতে প্রিয়পরিজনসহ রাজপুরীমধ্যে পুনঃপ্রবেশ করুন; আমরা মোহাম্মদ হানিফার অন্বেষণে যাই। চলুন এজিদের অশ্বচালনা দেখি।
এজিদ-বধ পর্ব ০৪ প্রবাহ
আশা মিটিবার নহে। মানুষের মনের আশা পূর্ণ হইবার নহে। ঘটনার সূত্রপাত হইতে শেষ পর্যন্ত অনেকের মনে অনেক প্রকারের আশার সঞ্চার হয়। আশার কুহকে মাতিয়া, অনেকে পথে অপথে ছুটিয়া বেড়ায়। ঘটনাচক্রে যতদূর গড়াইয়া লইয়া যায়, তাহাতেই বোধ হয় যেন পূর্ব আশা পূর্ণ হইল। এই পূর্ণ বোধ হইতে হইতে দুই তিন চারি, এমন কি, পঞ্চ প্রকারে আশা পঞ্চাশ ভাগে পঞ্চাশৎ বিভাগে ঘটনা-লিপ্ত মানুষের হৃদয়াকাশে সচঞ্চল চপলার ন্যায় ছুটিতে থাকে,-খেলিতে থাকে। জীবনের সহিত আশার সম্বন্ধ। আকাঙ্খার নিবৃত্তি আশার শান্তি, জীবনের ইতি, এই তিনেই এক, আবার একেই তিন। সুতরাং জীবন্ত দেহে মনের আশা মিটিবার নহে। আশা মিটিল না, মোহাম্মদ হানিফার মনের আশা পূর্ণ হইল না।