প্রভু আমার রণ-রঙ্গিণীদিগকে ভগ্নী-সম্ভাষণে কত অনুনয় বিনয় করিয়া যুদ্ধ-গমনে ক্ষান্ত করিয়া স্বয়ং যুদ্ধে গমন করিলেন। ঈশ্বর-কৃপায় মদিনাবাসীর সাহায্যে যুদ্ধে জয়লাভ হইল। বিজয়ী বীরগণকে মদিনা ক্রোড় পাতিয়া ক্রোড়ে লইল। আমার ভাবনা, চিন্তা এজিদের ভয় হৃদয় হইতে একেবারে সরিয়া গেল। এজিদের পক্ষ পরাস্ত, আনন্দের সীমা নাই! কিন্তু একটা কথা মনে হইল। এ যুদ্ধের কারণ কি? প্রকাশ্যে যাহাই থাকুক, লোকে যাহাই বলুক, রাজ্যলাভের সঙ্গে সঙ্গে জয়নাবলাভ-আশা যে এজিদের মনে না ছিল, তাহা নহে। ঈশ্বর রক্ষা করিলেন! কিন্তু জায়েদার চিন্তা, জয়নাবের সুখ-তরী বিষাদ-সিন্ধুতে বিসর্জন করা। সোনায় সোহাগা মিশিল। মায়মুনার ছলনায়, জায়েদা ইহকাল-পরকালের কথা ভুলিয়া, সপত্নীবাদে হিংসার বশবর্তিনী হইয়া স্বহস্তে স্বামীমুখে বিষ ঢালিয়া দিল। খর্জুর উপলক্ষ মাত্র। জায়েদার কার্য জায়েদা করিল কিন্তু ঈশ্বর রক্ষা করিলেন,-প্রাণ বাঁচিল, প্রভু রক্ষা পাইলেন। কিন্তু শত্রুর ক্রোধ দ্বিগুণ, চতুর্গুণ বাড়িয়া প্রাণবিনাশের নূতন চেষ্টা হইতে লাগিল। চক্রীর চক্র ভেদ করা কাহারো সাধ্য নহে। সেই মায়মুনার চক্রে, সেই জায়েদার প্রদত্ত বিষেই প্রভু আমার জগৎ কাঁদাইয়া জগতে চিরবিষাদ-বায়ু বহাইয়া স্বর্গধামে চলিয়া গেলেন। জয়নাবের কপাল!-পোড়া কপাল আবার পুড়িল। আবার বৈধব্যব্রত, সংসারসুখে জলাঞ্জলি!
হায়!-হায়!-পাপীয়সী জায়েদা আমাকে মহাবিষ না দিয়া প্রভু হাসানকে কেন বিষ দিয়া প্রাণসংহার করিল? আমার পরমায়ু শেষ করিয়া জগৎ হইতে দূর করিলে, আবার যে সেই হইত। আবার স্বামীর ভালবাসা নূতন করিয়া পাইত। তাহার মনের বিশ্বাসেই বলি,-হতভাগিনী জয়নাব জগৎ-চক্ষু হইতে চিরদিনের মত সরিলে,-তাহার স্বামী আবার তাহারই হইত। স্বামীর ভালবাসা-ক্ষেত্র হইতে জয়নাব-কণ্টক দূর হইলে আবার-প্রণয়কুসুম শতদলে বিকশিত হইত। তাহা করিল না কেন? পাপীয়সী সে সুপ্রশস্ত সরল পথে পদবিক্ষেপ না করিয়া এ-পথে, স্বামী-সংহার পথে কেন হাঁটিল? মায়মুনার পরামর্শ আর হিংসার সহিত দুরাশার সমাবেশ।-একত্র সম্মিলন। ক্ষুদ্রবুদ্ধিমতী বাহ্যিক সুখপ্রিয় বিলাসিনী রমণীগণের আকাক্সক্ষা উত্তেজনা।-রত্ন অলঙ্কার মহামূল্য বসনের অকিঞ্চিৎকর আকর্ষণ। অতুল ধনসম্পত্তির অধিকারিণী,-শেষে পাটরাণী হইবার আশার কুহক। পাটেশ্বরী হইয়া দামেস্ক রাজসিংহাসনে এজিদের বামপার্শ্বে বসিবার ইচ্ছা। স্ত্রীজাতি প্রায়ই বাহ্যিক সুখ-সম্ভোগপ্রিয়া। প্রভু হাসান-সংসারে বিলাসিতার নাম ছিল না। সে অন্তঃপুরে রমণী-মনোমুগ্ধকারী সাজ-সরঞ্জাম, উপকরণ-প্রচলন,-ব্যবহার দূরে থাকুক, ধর্মচিন্তা, ধর্মভাব, বিশুদ্ধ আচরণ ভিন্ন সুখ-সম্পদের ছটা নাম গন্ধের-অণুমাত্রও তাহার মনে ছিল না,-এজিদ-অন্তঃপুরে জগতের সুখে সুখী হইবার সকলই আছে, এজিদের মতে সেই প্রকার সুখসাগরে ভাসিবার আর বাধা কি? কয়দিন-স্ত্রীলোকের মন কয় দিন? দুরাশার বশবর্তিনী হইয়াই জায়েদার মতিচ্ছন্ন। মদিনার সিংহাসন শূন্য, প্রভুর জলপানের সুরাহীতে হীরকচূর্ণ।-হায়! এক কথা মনে উঠিতে কত কথাই মনে উঠেতেছে। এ কথা শুনে কে? মন তো কিছুতেই প্রবোধ মানে না। এখন এ সকল কথা মনে উঠিল কেন? উহু! আমি তো স্বামীর পদতলেই শয়ন করিয়া ছিলাম। প্রভু আমার বক্ষোপরি পবিত্র পদ দুখানি রাখিয়া নিদ্রাসুখ অনুভব করিতেছিলেন। পাপীয়সী জায়েদা কোন সময়ে কি প্রকারে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল। বিবি হাসনেবানুর এত সতর্কতা এত সাবধানতা,-খাদ্য সামগ্রী পানীয়জলে যত্ন ইহার মধ্যে কি প্রকারে কি করিল? আমার কপাল পুড়িবে, তাহা না হইলে নিদ্রাঘোরে অচেতন হইলাম কেন? কত রাত জাগিয়াছি, কত নিশা বসিয়া কাটাইয়াছি, হায়, হায়, সে রাত্রে নিদ্রার আকর্ষণ এতই হইল? জায়েদা বক্ষমধ্যে আসিয়া পানীয় জলে বিষ মিশাইল, কিছুই জানিতে পারিলাম না।-পাপীর অধোগতি দুর্গতি ভিন্ন সদ্গগতি কোথায়? আশা মিটিল না, যে আশার কুহকে পড়িয়া স্ত্রী ধর্মে জলা লি দিয়া স্বহস্তে স্বামীর মুখে বিষ ঢালিয়া দিল, সে আশায় ছাই পড়িল। পাপের প্রায়শ্চিত্ত হইল না কিন্তু কার্যফলের পরিণামফল ঈশ্বর একটু দেখাইয়া দিলেন। জায়েদার নব প্রেমাস্পদ কপট প্রেমিক প্রাণাধিক শ্রীমান্ এজিদ্হস্তে প্রকাশ্য দরবারে প্রতিজ্ঞা পরিপূরণ সহিত বিষময় বাক্যবাণ, শেষে পরমায়ুপ্রদীপ নির্বাণ করাইলেন। দরবারগৃহের সকল চক্ষুই দেখিল-জায়েদা আজ রাজরাণী-এজিদের বাম অঙ্কশোভিনী, স্বর্ণ সিংহাসনে পাটরাণী। সেই মুহূর্তেই সেই চক্ষেই আবার দেখিল-অস্ত্রাঘাতে এজিদ্হস্তে জায়েদার মুণ্ডপাত। জায়েদার ভবলীলা সাঙ্গ হইল। দরবার গৃহের মর্যাদা রক্ষা পাইল। বিচার আসনের গৌরব বৃদ্ধি হইল। আমার মনের কথার ইতি হইল না। মায়মুনাও পুরস্কারের স্বর্ণমুদ্রা গণিয়া লইতে পারিল না।
পুনরায় জয়-জয়কার, ক্রমেই যেন নিকটবর্তী। কান পাতিয়া শুনিলেন, জনকোলাহল ক্রমেই বৃদ্ধি-মুখে বলিলেন, “আজ এত গোল কিসের? কী হইল? কী ঘটিল? যাক্ ও গোলযোগে আমার লাভ কি? মনে কথা উথলিয়া উঠিতেছে।”
স্থির করিলাম, এ পবিত্রপুরী জীবনে পরিত্যাগ করিব না। যেখানেই যাইব, নিস্তার নাই। এজিদের হস্ত হইতে জয়নাবের নিস্তার নাই। ভাবিয়া, প্রভু হোসেনের আশ্রয়েই রহিলাম। এজিদের আশা যেমন তেমনি রহিয়া গেল। এত চেষ্টা, এত যত্ন, এত কৌশলেও জয়নাব হস্তগত হইল না, সম্পূর্ণ বিঘ্নই আশ্রয়দাতা। আশ্রয়দাতাকে ইহজগৎ হইতে দূর করাই এজিদের আন্তরিক ইচ্ছা, প্রকাশ্যে রাজ্যলাভের কথা কিন্তু মনের মধ্যে অন্য কথা। এজিদের চক্রেই প্রভু হোসেনের কুফায় গমন সংবাদ। পরিজনসহ প্রভু হোসেন কুফায় গমন করিলেন। হতভাগিনীও সঙ্গে চলিল। হায়! কোথায় কুফা, কোথায় র্কাবালা! র্কাবালার ঘটনা মনে আছে সকলই, কিন্তু মুখে বলিবার সাধ্য নাই। হায়! আমার জন্য কি না হইল! মহাপ্রান্তর র্কাবালাক্ষেত্রে রক্তের নদী বহিল। শত শত সতী, পতিহারা, পুত্রহারা হইয়া আজীবন চক্ষের জলে ভাসিতে লাগিল। মহা মহা বীরসকল, এক বিন্দু জলের জন্য লালায়িত হইয়া শত্রু-হস্তে অকাতরে প্রাণ সমর্পণ করিল। কত বালক বালিকা শুষ্ককণ্ঠ হইয়া ছট্ফট্ করিতে করিতে, পিতার বক্ষে মাতার ক্রোড়ে দেহত্যাগ করিয়া অনন্তধামে চলিয়া গেল। কাসেম-সখিনার কথা মনে হইলে, এখনো অঙ্গ শিহরিয়া উঠে। শোকসিন্ধুমধ্যে বিবাহ, কি নিদারুণ কথা। কাসেম-সখিনার বিবাহ কথা মনে পড়িলে প্রাণ ফাটিয়া যায়! সে দুর্দিনের শেষ ঘটনায় যাহা ঘটিবার ঘটিয়া গেল। বিশ্বপতি বিশ্বেশ্বরের মহিমা প্রকাশ হইল। সে অনন্ত ইচ্ছাময়ের ইচ্ছা পূর্ণ করিতে কাহারো বাধা দিবার ক্ষমতা নাই প্রভু হোসেন তাহারই দৃষ্টান্ত দেখাইয়া সীমারের খ রে দেহত্যাগ করিলেন। ‘হায়! হোসেন!’ ‘হায়! হোসেন!’ রবে প্রকৃতির বক্ষ ফাটিতে লাগিল। আমরা তখনই বন্দিনী। নূরনবী মোহাম্মদের পরিজনগণ তখনই বন্দিনী। দামেস্কে আসিলাম। আর রক্ষা নাই। এজিদ্-হস্ত হইতে আর নিস্তার নাই। ডুবিলাম, আর উপায় নাই। নিরাশ্রয়ার আশ্রয়ই ঈশ্বর, আশা ভরসা যাহা যাহা সম্বল ছিল, ক্রমে হৃদয় হইতে সরিয়া এক মহাবলের সঞ্চার হইল। এজিদ্ নামে আর কোন ভয়ই রহিল না। এই ছুরিকা হস্তে করিতেই মন যেন ডাকিয়া বলিল,-“এই অস্ত্র-দুরাচারের মাথা কাটিতে এই অস্ত্র।” সাহস হইল, বুকেও বল বাঁধিল। পারিব-সে অমূল্য রত্ন, রমণীকুলের মহামূল্য রত্ন দস্যু-হস্ত হইতে রক্ষা করিতে পারিব। প্রতিজ্ঞা করিলাম, হয় দস্যুর জীবন নয় ধনাধিকারিণীর জীবন এই ছুরিকার অগ্রে,-হয় এজিদের বক্ষে প্রবেশ করিবে, নয় জয়নাবের চির-সন্তাপিত হৃদয়ের শোণিত পান করিবে। আর চিন্তা কি! নির্ভয়ে, সাহসে নির্ভর করিয়া বসিলাম। পাপীর চক্ষু এ পাপচক্ষে কখনোই দেখিব না ইচ্ছা ছিল। কিন্তু নিয়তির বিধানে সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা হইল না। দামেস্কে আসিবামাত্রই এজিদের আজ্ঞা প্রতিপালন করিতে হইল। পাপীর কথা শুনিলাম, উত্তর করিলাম, সঙ্গে সঙ্গে ছুরিকাও দেখাইলাম। মহাপাপীর হৃদয় কম্পিত হইল। মুখের ভাবে বুঝিলাম, নিজ-প্রাণের ভয় অপেক্ষা জয়নাবের প্রাণের ভয়ই যেন তাহার অধিক। কি জানি জয়নাব যদি আত্মহত্যা করে তবেই তো সর্বনাশ।