পাপাত্মা এজিদ্ মনোসাধ পূর্ণ করিবার আশা পথ পরিষ্কার করিয়া অগ্র-পশ্চাৎ না ভাবিয়া তাহার নিজ মনের ভাব ও গতি অনুসারে কাসেদ পাঠাইবার স্থির সিদ্ধান্ত করিয়াছিল। স্ত্রীলোক যাহা চায় তাহাই আমার আছে। ধনরত্ন অলঙ্কারের তো অভাব নাই। তাহার উপর দামেস্করাজ্যের পাটরাণী। প্রভু হাসানের প্রস্তাব শুনিয়া এজিদের ধনরত্ন পদমর্যাদা দামেস্কের সিংহাসন এই পায়ে দূরে নিক্ষেপ করিয়া মোস্লেমের শেষ প্রস্তাবেই স্বীকৃত হইলাম, পরিণয়-গ্রন্থি ছিন্ন হওয়ার পর আর সংসারে মন লিপ্ত হইল না। পরকালের উদ্ধার চিন্তাই বেশি হইয়াছিল। জগৎ কিছু নয়-সকলই অসার। ধনজন-স্বামী-পুত্র-মাতা-পিতা কেউ কাহার নয়, যা কিছু সত্য, সম্পূর্ণ সত্য সেই সৃষ্টিকর্তা বিধাতা। পরকালে মুক্তি হইবে, সেই আশাতেই প্রভু হাসানের মুখ পানেই চাহিলাম। কিন্তু বড় কঠিন প্রশ্নে পড়িলাম! একদিকে ধর্ম ও পরকাল অন্যদিকে জগতের অসীম সুখ,-অনেক চিন্তার পর প্রথম সঙ্কল্পের দিকেই মন টানিল। মহারাণী হইতে ইচ্ছা হইল না। সময় কাটিয়া গেল, বৈধব্যব্রত সাঙ্গ হইল। সময়ে প্রভু হাসানের দর্শন লাভ হইল। ঈশ্বরকৃপায় সে সুকোমল পদসেবা করিবার অধিকারিণী হইলাম। প্রভু ধর্মশাস্ত্রমতে আমার পাণিগ্রহণ করিলেন। আবার সংসারী হইলাম। প্রভু হাসান অতি সমাদরে মদিনায় লইয়া নিজ অন্তঃপুরে আশ্রয় দিলেন। নূতন সংসারে অনেক নূতন দেখিলাম। পবিত্র অন্তঃপুরে পবিত্রতা, ধর্মচর্চা, ধর্মমতে অনুষ্ঠান, ধর্মক্রিয়া অনেক দেখিলাম; অনেক শিখিলাম। মুক্তিক্ষেত্রে আশালতার অঙ্কুরিত ভাব দেখিয়া মনে কথঞ্চিৎ শান্তিলাভ হইল। কিন্তু সংসারচক্রের আবর্তে পড়িয়া-সপত্নী মনোবাদ হিংসা আগুনে জ্বলিয়া-পুড়িয়া খাক হইতে হইল। তাহাতেই বুঝিলাম, জগতে সুখ কোথাও নাই। দৈহিক জীবনে মনের সুখ কোন স্থানেই নাই। রাজা প্রজা ধনী নির্ধন দুঃখী ভিখারী মহামানী মহামহিমা বীরকেশরী আন্তরিক সুখ সম্বন্ধে সকলেই সমান-রাজরাণী ভিখারিণী ধনীর সহধর্মিণী দুঃখিনীর নন্দিনী সকলেরই মনের সুখ সমতুল্য।-প্রাণে আঘাত লাগিলে মুখ বন্ধ থাকে না। পবিত্র পুরীমধ্যে থাকিয়া এই হতভাগিনী-সপত্নীবাদেই সমধিক মনোবেদনা ভোগ করিয়াছে। সপত্নীসহ একত্রে বাস, এক প্রকার জীয়ন্তে নরক ভোগ। আমি কিন্তু প্রকাশ্যে ছিলাম ভাল। কারণ যেখানে প্রভুর আদর,-সেখানে অন্যের আদরের দুঃখ কি? সপত্নীবাদেও রহস্য আছে।-যেখানে সপত্নীবাদ সেইখানেই শুনা যায় স্বামী-চক্ষে কনিষ্ঠা স্ত্রীই আদরের ও পরম রূপবর্তী-পূর্বে জায়েদার ভাগ্যাকাশে যে যে প্রকারে স্বামী-ভালবাসার তারকারাজি ফুটিয়া চমকিয়াছিল,-আমার ভাগ্যবিমানেও তাহাই ঘটিল। আমিই যখন কনিষ্ঠা স্ত্রী, স্বামী-ভালবাসার আমিই সম্পূর্ণ অধিকারিণী। সাধারণ মতে আমিই স্বামীর হৃদয়-অন্তর-প্রাণ ষোল-আনা অধিকার করিয়া বসিয়াছি-এই কারণে আমি জায়েদার চক্ষের বিষ। এই কারণেই স্বামীবধে মহা বিষের আশ্রয়। এ কি বিষের কথাতেই এত কথা মনে হইল? প্রভু অন্তঃপুরে জায়েদার চক্ষের বিষ, জ্বলন্ত অঙ্গার হইয়াই বাস করিতে হইল। স্বামীর হাব-ভাব বিচার-ব্যবস্থায় তিন স্ত্রী মধ্যে প্রকাশ্যে ইতরবিশেষ কিছুই ছিল না। জায়েদার চক্ষে আমি যাহা-কিন্তু হাসনেবানুর চক্ষে তাহার বিপরীত। স্বামীগত-প্রাণ স্বামীকে অকপটে হৃদয়ের সহিত ভালবাসেন। সেই ভালবাসা-স্বামীর গুপ্ত ভালবাসা আমাকে ভাবিয়া-ভালবাসার ভালবাসা জ্ঞানে আমাকেও হৃদয়ের সহিত ভালবাসিলেন। বিশ্বাস করিলেন-ভালবাসার কারণ আর আমার মনে হইল যে, সপত্নী জায়েদা তাঁহার অন্তরে যে প্রকার দুঃখ দিয়াছিল, আমা দ্বারা তাহার পরিমাণ অনুযায়ী পরিশোধ হইল ভাবিয়াও বোধ হয় আমি ভালবাসা পাইলাম। জায়েদাকে তিনি যে প্রকারে বিষনয়নে দেখিতেন, জায়েদা আমাকে সেই বিষনয়নে দেখিতে লাগিল। সুতরাং শত্রুর শত্রু মিত্র। ইহাতেই আমি হাসনেবানুর প্রিয়-সপত্নী। সপত্নী সম্পর্ক কিন্তু স্নেহে-আদরে-ভালবাসায় প্রিয়তমা সহোদরা। জ্যেষ্ঠা ভগিনী কনিষ্ঠাকে যে যে প্রকারের সুমিষ্ট বচনে উপদেশ আজ্ঞায় সতর্ক করেন, হাসনেবানু আমাকে সেই প্রকারে ভালবাসার সহিত নানা বিষয়ে সাবধান সতর্ক করিলেন। আমিও তাঁহাকে ভক্তির চক্ষে দেখিয়াছি, এপর্যন্ত দেখিতেছি। কোন সময়ে জায়েদা বিবির সহিত চোখে মুখে নজর পড়িলে সর্বনাশ, সে তীব্র চাহনীর ভাব যেন এখনো আমার চক্ষের উপর আঁকা রহিয়াছে বোধ হয়। পারেন তো চক্ষের তেজে আমাকে দগ্ধ করিয়া ছাই করেন, জীবন্ত গোরে পুতিতে পারিলেই যেন নিশ্বাস ফেলিয়া বাঁচেন। এমনি রোষ, এমনি হিংসার তেজ যে অমন সুন্দর মুখখানি আমার মুখের উপর নজর পড়িতেই যেন বিকৃত হইত, কে যেন এক পেয়ালা বিষ,-মুখের উপর ঢালিয়া দিত। কিছু দিন যায়, এক দিন অতি প্রত্যূষে মেঘের গুড় গুড় শব্দের ন্যায় ডঙ্কা, কাড়া-নাকাড়া ধ্বনি কানে আসিল। মনে আছে-খুব মনে আছে। প্রভাত হইতে না হইতেই মদিনাবাসীরা ঈশ্বরের নাম করিয়া বীরমদে মাতিয়া উঠিল; দেখিতে দেখিতে যুবা বৃদ্ধ সকলের শরীরেই চর্ম, বর্ম, তীর, তরবারি শোভা পাইতে লাগিল। রূপের আভা, অস্ত্রের আভা, সজ্জিত আভায়, সমুদিত দিনমণির অদ্বিতীয় উজ্জ্বলাভা সময়ে সময়ে যেন মলিন বোধ হইতে লাগিল।
প্রভুও সজ্জিত হইলেন। বীরসাজে সাজিলেন। সে সাজ আমার চক্ষে সেই প্রথম। এখনো যেন চক্ষের উপরে ঘুরিতেছে। দেখিলাম, প্রভুই সকলের নেতা; কিছুক্ষণ পরেই দেখি, বীরপ্রসবিনী মদিনার বীরাঙ্গনাগণ মুক্তকেশে অসিহস্তে দলে দলে প্রভুর নিকটে আসিয়া যুদ্ধে যাইতে ব্যগ্রতা প্রকাশ করিলেন। কাহার সহিত যুদ্ধ-কে সে লোক-যে কুলের কুলবধূরা পর্যন্ত অসিহস্তে সে মহাপাপীর বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইয়াছে? শেষে শুনিলাম এজিদের আগমন, মদিনা আক্রমণের উপক্রম। ধন্য মদিনা! বিধর্মীর হস্ত হইতে ধর্ম রক্ষা, স্বাধীনতা রক্ষা, জাতীয় জীবন রক্ষা হেতু নারী-জীবনে রণ-বেশ, কোমল করে লৌহ অস্ত্র! হৃদয়ের সহিত তোমার নমস্কার করি।