কেন নাই? এদিকে একটি প্রাণীও নাই। যেদিকে থাকিবার সেদিকে আছে। প্রভু হোসেন পরিবার যেদিকে বন্দি, সেদিকের কোন পরিবর্তন হয় নাই। সেই কণ্ঠনিনাদ, সেই স্ত্রীকণ্ঠে আর্তবিলাপ, সেই মর্মান্তিক বেদনাযুক্ত গত কথা, কিন্তু ভাব ভিন্ন, অর্থ ভিন্ন, কণ্ঠ ভিন্ন।-
হায়! কোথায় আমি-জয়নাব। সামান্য ব্যবসায়ী দীনহীন দরিদ্রের কুলবধূ। দৈহিক শ্রমোপার্জিত সামান্য অর্থাকাক্সক্ষীর সহধর্মিণী, রাজাচার, রাজব্যবহার-রাজপরিবারগণের অতি উচ্চ সুখ-সম্ভোগের সহিত আমার সম্বন্ধ কি? আমি রাজ অন্তঃপুরে কেন? মদিনার পবিত্র রাজপুরী মধ্যে জয়নাবের বাস অতি আশ্চর্য! দামেস্কের রাজকারাগারে বন্দিনী, সে আরো আশ্চর্য। আমার সহিত এ কারাগৃহের সম্বন্ধ কি? হায়! আমার নিজ জীবনের আদি অন্ত ঘটনা মনোযোগের সহিত ভাবিয়া দেখিলে প্রত্যক্ষ প্রমাণের সহিত সপ্রমাণ হইবে, এই হতভাগিনীই বিষাদ-সিন্ধুর মূল। জয়নাবই এই মহাপ্রলয় কাণ্ডের মূল কারণ। হায়! হায়! আমার জন্যই নূরনবী মোহাম্মদের পরিবার-পরিজন প্রতি এই সাংঘাতিক অত্যাচার! হায় রে! আমার স্থান কোথা? আমি পাপীয়সী! আমি রাক্ষসী! আমার জন্য ‘হাবিয়া’ নরকদ্বার উদ্গঘাটিত রহিয়াছে। কী পরিতাপ! আমারই জন্য জায়েদার কোমলান্তরে হিংসার সূচনা। এ হতভাগিনীর রূপ গুণেই জায়েদার মনের আগুন দ্বিগুণ ত্রিগুণ পঞ্চগুণে বৃদ্ধি। অবলা প্রাণে কত সহিবে? পতিপ্রাণা ললনা আর কত সহ্য করিবে? সপত্নীবাদে মনের আগুন নির্বাণ হয়? সপত্নী ছাড়িয়া শেষে স্বামীকেই আক্রমণ করে। মন যাহা চায় নিয়তির বিধান থাকিলে তাহা পাইতে কতক্ষণ! খুঁজিলেই পাওয়া যায়। মায়মুনার মনোসাধ পূর্ণ করিতে জায়েদার প্রয়োজন। জায়েদার মনোসাধ পূর্ণ করিতে মায়মুনার আবশ্যক। সময়ে উভয়ের মিলন হইল, সোনায় সোহাগা মিশিল। শেষে নারী-হস্তে উহু! মুখে আনিতেও হৃদয় ফাটিয়া যায়। বিষ-মহাবিষ। (নীরব)।
কর্ণে শুনিতেছেন, নগরের জনকোলাহল, সৈন্যগণের ভৈরব নিনাদ-কাড়া-নাকাড়া দামামার বিঘোর রোল। মধ্যে মধ্যে জয় উল্লাস সহিত জয়নাল আবেদীনের নাম। মৃদুমৃদু স্বরে বলিতে লাগিলেন,-এ কী! আজি আবার এ কি শুনি! এত জনকোলাহল কিসের জন্য? অনেকক্ষণ স্থিরকর্ণে স্থির মনে রহিলেন, কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। অন্যদিকে চাহিয়া দেখিলেন, বন্দিগৃহের দ্বারে দ্বারে যেখানে রক্ষিগণ পাহারা দিতেছিল, সেখানে কেহই নাই।-সমুদয় দ্বার উন্মুক্ত। দক্ষিণে চাহিয়া দেখিলেন, বিবি সালেমা, সাহারবানু, হাসনেবানু ম্লান বদনে নীরবে বসিয়া রহিয়াছেন। ক্ষণে ক্ষণে সাহারবানু কাতরকণ্ঠে বলিতেছেন, “ওরে বাপ্। বাবা জয়নাল! তুই কোথা গেলি বাপ্? তুই আমার কোলে আয় বাপ্!”-জয়নাল যে স্থানে বসিয়াছিলেন সেই স্থানেই রহিলেন এবং পূর্ব কথা বলিতে লাগিলেন।
উহু! বিষ!-জায়েদার হস্তে বিষ!! যদি জয়নাব হতভাগিনী হাসানের দাসীশ্রেণী মধ্যে পরিগণিতা না হইত, যদি রূপ-গুণ না থাকিত, যদি স্বামীসোহাগিনী না হইত, তাহা হইলে জায়েদার হস্তে কখনোই বিষ উঠিত না। মায়মুনার কথা কখনোই শুনিত না।-এই হতভাগিনীর জন্যই বিষ! এজিদ্ মুখে শুনিয়াছি, সৈন্য সামন্ত লইয়া মৃগয়া যাইতে গবাক্ষ-দ্বারে আমাকে দেখিয়াছিল। কত চক্ষু এজিদ্কে দেখিতে আগ্রহ প্রকাশ করিল, আমি নাকি ঘৃণার চক্ষে দেখিয়া গবাক্ষ-দ্বার বন্ধ করিয়া দিয়াছিলাম। আমার তো কিছুই মনে হয় না, পাপিষ্ঠ আরো বলিল, সে দিন আমার মস্তকোপরি চিকুর সংলগ্ন মুক্তার জালি ছিল। কর্ণে কর্ণাভরণ দুলিতেছিল। ছি ছি! কেন গবাক্ষ-দ্বার খুলিয়া দাঁড়াইয়াছিলাম, সেই কুলক্ষণ গবাক্ষ-দ্বারে অবস্থানই আমার কাল হইয়াছিল। এই মহা দুর্ঘটনার প্রধান কারণই গবাক্ষ-দ্বারে অবস্থান। বিনা এখন বুঝিলাম, সেই সাহিনামার মর্ম। এখন বুঝিলাম, রাজপ্রাসাদে আবদুল জাব্বারের আহ্বান। এখন বুঝিলাম সামান্য দরিদ্র গৃহে রাজ কাসেদের নামা লইয়া গমন, আবদুল জাব্বারের নিমন্ত্রণের মন্ত্রণা সকলই চাতুরী। এরূপ আহ্বান আদর সমাদর নামা প্রেরণ সকলই আমার জন্য। এজিদের চাতুরী আবদুল জাব্বার কি বুঝিবে? রাজজামাতা হইয়া আশার অতিরিক্ত সুখভোগ করিবে, সামান্য ব্যবসায়ী সামান্য অর্থের জন্য যে লালায়িত সেই রাজকুমারী সালেহাকে লাভ করিয়া জীয়ন্তে স্বর্গসুখ ভোগ করিবে, নরলোকে বাস করিয়া স্বর্গীয় অপ্সরার সহিত মিলিত হইয়া পরমাত্মাকে শীতল করিয়া সুখী হইবে। সেই আশাতেই আমাকে বিনা অপরাধে পরিত্যাগ করিল। কী নিষ্ঠুর। কী নির্দয়! কী কপট! সেই শাহিনামা প্রাপ্তির পূর্বক্ষণ, আমার দুঃখ দেখিয়া কত আক্ষেপ, কত মনোবেদনা প্রকাশ,-কী কপট! রন্ধনশালাকার্যে অগ্নির উত্তাপে মুখে ঘর্ম-বিন্দু মুক্তা বিন্দু আকারে ফুটিয়াছিল। ছাই কয়লার কালি বস্ত্রে হস্তে লাগিয়াছিল। সম্মুখে দর্পণ ধরিয়া দর্পণে আমার ছায়া আমাকে দেখান হইল, টাকা থাকিলে কি এত দুঃখ তোমার হয়? আমার প্রাণে কি ইহা সহ্য হয়! কত প্রকার আক্ষেপ করিয়াছিল, তাহার প্রত্যক্ষ ফল হাতে হাতে দেখাইল। সেই দিনই দামেস্কে যাত্রা।-রাজপ্রাসাদে সাদরে গৃহীত। যেমনি প্রস্তাব অমনি অনুমোদন।-আমাকে পরিত্যাগ। ধন্য বিবি সালেহা! স্পষ্ট উত্তর করিলেন-এক স্ত্রীর সহিত যখন এই ব্যবহার-অর্থলোভে চিরপ্রণয়ী প্রিয় পত্নীকে পরিত্যাগ। আর বিশ্বাস কি? বিবাহে অস্বীকার-যেমন কর্ম তেমনি ফল। এজিদেরই জয়! এজিদেরই মন-আশা পূর্ণ। কৌশলে জয়নাবকে হস্তগত করিবার উপায়পথ আবিষ্কার। আবদুল জাব্বারের হা-হুতাশ-পরিতাপ সার। রাজপুরী হইতে গুপ্তভাবে বহির্গত-জনতার মধ্যে আত্মগোপন। সংসারে ঘৃণা, পরিণামে ফকিরী গ্রহণ। সকলই সেই ইচ্ছাময়ের ইচ্ছা! আমার অদৃষ্টে যাহা লেখা ছিল তাহা হইয়া গেল। বিধবা হইলাম। পূর্ণ বয়সে স্বামী সুখে বঞ্চিত হইলাম। আর কোথায়? কোথায় যাইব। পিত্রালয়ে আসিলাম।