“ঈশ্বর-প্রেমিকগণ এবং তাঁহাদের পরিবারগণ কি প্রকারে সংসারচক্রের আবর্তে পড়িয়া এত কেশ, এত দুঃখ ভোগ করেন, কারণ হয়ত অনেকেই অনুসন্ধান করেন নাই। বুঝিলে এ প্রশ্নের উত্তর বোধ হয় অতি সহজে মীমাংসা হয়। প্রেমিকের প্রেম পরীক্ষাই ইহার মূলতত্ত্ব এবং তাহাই উদ্দেশ্য। দৈহিক কষ্ট জগতে কিছুই নহে। আত্মার বল এবং পরকালের সুখই যথার্থ সুখ। অনন্তধামের অনন্ত সুখভোগই যথার্থ সুখ-সম্ভোগ!
“দামেস্কনগরের মাননীয় বন্ধুগণ! আপনারা পূর্ব হইতেই ইমাম-বংশের প্রতি মনে মনে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করিয়া আসিতেছেন, তাহার প্রমাণ ইতিপূর্বে আমাদের এই নবীন ভূপতির কারাগার অবস্থায় খোৎবা পাঠ সময়ে ঘটনার কথায় শুনিয়াছি। ভাগ্যক্রমে অদ্য স্বচক্ষেই দেখিতেছি। ঈশ্বর ইঁহাদের মঙ্গল করুন। রাজানুগ্রহ চিরকাল ইঁহাদের প্রতি সমভাবে থাকুক। ইহাই সেই সর্বাধীশ্বরের নিকট কায়মনে প্রার্থনা করি।”
দামেস্ক-নগরস্থ ইমামভক্ত দলপতিগণের মধ্য হইতে মহাসম্ভ্রান্ত এবং মাননীয় কোন মহোদয় দণ্ডায়মান হইয়া বলিতে লাগিলেন, “আমরা চিরকালই হজরত নূরনবী মোহাম্মদের আজ্ঞাবহ দাসানুদাস, মহাবীর হজরত মুরতজা আলীর চিরভক্ত। মধ্যে কয়েক দিন মহামহিম হজরত মাবিয়ার আনুগত্য স্বীকার করিয়া নিশ্চিন্তভাবে ধর্ম কর্ম রক্ষা করিয়া সংসার যাত্রা নির্বাহ করিয়াছি। হজরত মাবিয়ার পীড়ার সময় হইতেই আমাদের দুর্দশার সূচনা আরম্ভ হইয়াছিল। তাহার পর মন্ত্রিপ্রবর হামানের অপদস্থ হওয়ায় এবং এজিদ্ দরবারে বৃদ্ধ মন্ত্রীর বয়স-দোষে বুদ্ধি-বিবেচনায় ভ্রম জন্মিয়াছে, মারওয়ানের বিবেচনায় এই কথা সাব্যস্ত হওয়ার পর হইতেই আমাদের দুর্দশার-পথ সহজেই পরিষ্কার হইয়াছে। আর কোথায় যাই, এই প্রকার জীবন্মৃতপ্রায় হইয়া দামেস্কে বাস করিতেছিলাম। এইক্ষণে দয়াময় জগদীশ্বর, যাঁহাদের রাজ্য, তাঁহাদের হস্তেই পুনঃ অর্পণ করিলেন; আমাদের জ্বালা, যন্ত্রণা, দুঃখ সকলই ইহকাল পরকাল হইতে উপশম হইল। আমরা দুই হস্ত তুলিয়া সর্বশক্তিমান ভগবান সমীপে প্রার্থনা করিতেছি যে, মহারাজাধিরাজ জয়নাল আবেদীনের রাজমুকুট চিরকাল অক্ষুণন্নভাবে পবিত্র শিরে শোভা করুক। আমরাও মনের সহিত রাজসেবা করি, পুণ্যভূমি মদিনার অধীনস্থ হইয়া চিরকাল গৌরবের সহিত সংসারযাত্রা নির্বাহ করিতে থাকি। মদিনার অধীনতা স্বীকার করিতে কাহার না ইচ্ছা হয়? আমরা সর্বান্তঃকরণে মহারাজ জয়নাল আবেদীনের মঙ্গল কামনা করি। আজ মনের আনন্দে নবীন মহারাজের বিজয় ঘোষণা করিয়া মনের আবেগ দূর হইল। শান্তি-সুখে সুখী হইয়া ভাগ্যবান হইলাম।”
বক্তার কথা শেষ হইতে-না-হইতেই শাহী দরবার হইতে সহস্রমুখে “জয় জয়নাল আবেদীন” রব উচ্চারিত হইয়া প্রবাহিত বায়ুর সহিত প্রতিযোগিতায় প্রতিধ্বনি হইতে লাগিল, “জয় জয়নাল আবেদীন!” সকলেই নতশিরে নবীন মহারাজের সিংহাসন চুম্বন করিলেন এবং যথোপযুক্ত উপঢৌকনাদি রাজগোচর করিয়া অধীনতা স্বীকার করিলেন। ইহকাল এবং পরকালের আশ্রয়দাতা, রক্ষাকর্তা বলিয়া শত শত বার সিংহাসন চুম্বন করিলেন। সে সময় সাদিয়ানা বাদ্য বাদিত না হইয়া রণবাদ্যই বাজিতে লাগিল। কারণ এজিদের কোন সংবাদ নাই, এজিদ্-বধের কোন সমাচারপ্রাপ্ত হওয়া যায় নাই। দরবার বরখাস্ত হইল। মহারাজ জয়নাল আবেদীন, গাজী রহমানের মন্ত্রণায়, জননী, ভগ্নী এবং অন্যান্য পরিজনকে বন্দিগৃহ হইতে রাজপুরী মধ্যে আনয়ন করিতে ওমর আলী ও আক্কেল আলী সহ রাজপ্রাসাদ হইতে বন্দিগৃহে যাত্রা করিলেন। অন্যান্য রাজগণ কিঞ্চিৎ বিশ্রাম সুখ প্রয়াসী হইয়া বিশ্রাম-ভবনে গমন করিলেন। দ্বারে দ্বারে প্রহরী খাড়া হইল। সৈন্যাধ্যক্ষগণ, সৈন্যগণ, দামেস্ক সৈন্যনিবাসে যাইয়া, সজ্জিত কক্ষ সকল নির্দিষ্টরূপে গ্রহণ করিয়া বিশ্রাম-সুখ অনুভব করিতে লাগিলেন।
এজিদ-বধ পর্ব ০৩ প্রবাহ
দয়াময় ভগবান! তোমার কৌশল-প্রবাহ কখন কোন পথের কত ধারে যে অবিরত ছুটিতেছে, কৃপাবারি কখন কাহার প্রতি কত প্রকারে কত আকারে যে ঝরিতেছে তাহা নির্ণয় করিয়া বুঝিবার সাধ্য জগতে কাহারো নাই। সে লীলা-খেলার যথার্থ মর্ম কলমের মুখে আনিয়া সকলকে বুঝাইয়া দিবার ক্ষমতাও কোন কবির কল্পনায় নাই। কাল জয়নাল আবেদীন দামেস্ক কারাগারে এজিদ্হস্তে বন্দি, প্রাণভয়ে আকুল; আজ সেই দামেস্ক-সিংহাসন তাঁহার বসিবার আসন, রাজ্যে পূর্ণ অধিকার, রাজপুরী পদতলে, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি প্রাণ তাঁহার করমুষ্টিতে। কাল বন্দিবেশে বন্দিগৃহ হইতে পলায়ন, শূলে প্রাণবধের ঘোষণা শুনিয়া পর্বত-গুহায় আত্মগোপন, নিশীথ সময়ে স্বজন-হস্তে পুনরায় বন্দি, চির শত্রু মারওয়ান সহ একত্র এক সময় বন্দি; আর হামান জীবনের মত বন্ধন-দশা হইতে মুক্তিলাভ করিয়াছে, আর জয়নাল আবেদীনের শিরে রাজমুকুট শোভা পাইতেছে। ধন্য রে কৌশলী। ধন্য, ধন্য তোমার মহিমা!
আবার এ কী দেখিতেছি! এখনই কী দেখিলাম, আবার এখনই-বা কী দেখিতেছি! এই কি সেই বন্দিগৃহ! যে বন্দিগৃহের কথা মনে পড়িলে অন্তরাত্মা কাঁপিয়া উঠে, হৃদয়ের শোণিতাংশ জলে পরিণত হয়, এ কি সেই বন্দিগৃহ! যে সূর্যাধিকারে একবার দেখিয়াছি, এখনো সে অধিকার বিলুপ্ত হয় নাই, এখনো সে লোহিত সাজে সাজিয়া পররাজ্যে দেখা দিতে জগৎ-চক্রে চক্ষুর অন্তরাল হয় নাই, ইহারই মধ্যে এই দশা! এত পরিবর্তন! কই, সে যমদূত-সদৃশ প্রহরী কই? সে নির্দয় নিষ্ঠুরেরাই বা কোথায়? শাস্তির উপকরণ লৌহশলাকা, জিঞ্জির, কটাহ, মুষল, সকলই পড়িয়া আছে। জীবন্ত জীব কোথায়? কই, কাহাকেও তো দেখিতেছি না? কেবল দেখিতেছি-জীবন-শূন্য দেহ আর চর্ম-শূন্য মানব শরীর!