নবভূপতি মহারথিগণে বেষ্টিত হইয়া, ঈশ্বরের নাম করিতে করিতে রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হইয়া “আল্হাম্দুলিল্লাহ্” বলিয়া রাজসিংহাসনে উপবেশন করিলেন। বিজয় বাজনা বাজিতে লাগিল। রাজ-নিশান শতবার শির নামাইয়া দামেস্কাধিপতির বিজয় ঘোষণা করিল। অন্যান্য রাজগণ নতশিরে অভিবাদন করিয়া রাজসিংহাসনের মর্যাদা রক্ষা করিলেন, এবং রক্তমাখা শরীরে, রক্তমাখা তরবারি হস্তে যথোপযুক্ত আসনে, রাজ-আদেশে উপবেশন করিলেন। সৈন্যগণ নিষ্কোষিত অসি হস্তে নবভূপতির বিজয় ঘোষণা করিয়া নতশিরে অভিবাদন করিলেন।
গাজী রহমান রাজসিংহাসন চুম্বন করিয়া বলিতে লাগিলেন, “ভিন্ন দেশীয় মহামাননীয় ভূপতিগণ! রাজন্যগণ! মাননীয় প্রধান প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষগণ! সৈন্যগণ! যুদ্ধ-সংস্রবী বীরগণ! এবং সভাস্থ বন্ধুগণ! দয়াময় ঈশ্বরের প্রসাদে এবং আপনাদের বলবিক্রমের সহায়ে ও সাহায্যে আজ জগতে অপূর্ব কীর্তি স্থাপিত হইল। ধর্মের জয়, অধর্মের ক্ষয়-তাহারও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জ্বলন্ত রেখায় ইতিহাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় অঙ্কিত রহিল। এই দামেস্ক-সিংহাসন আজ বক্ষ পাতিয়া যে ভূপতিকে উপবেশন স্থান দিয়াছে, ইহা এই নবভূপতিরই পৈতৃক আসন। যে কারণে এই আসন হজরত মাবিয়ার করতলস্থ হয়, তদ্বিবরণ এইক্ষণ উল্লেখ করা দ্বিরুক্তি মাত্র। বোধ হয়, আপনারা সকলেই তাহা অবগত আছেন। মহাত্মা মাবিয়া যে যে কারণে এজিদের প্রতি নারাজ হইয়া যাঁহাদের রাজ্য তাঁহাদিগকে পুনরায় প্রতিদান করিতে কৃতসংকল্প হইয়াছিলেন, যে কৌশলে এজিদ্ মহামান্য প্রভু হাসান-হোসেনকে বঞ্চনা করিয়া এই রাজ্য যেভাবে আপন অধীনে রাখিয়াছিলেন, সে বিষয় কাহারো অবিদিত নাই। ইমাম বংশ একেবারে ধ্বংস করিয়া নির্বিবাদে দামেস্ক এবং মদিনারাজ্য একচ্ছত্ররূপে ভোগ করিবার অভিলাষ করিয়া যে কৌশলে এজিদ্-প্রভু হাসানের প্রাণ বিনাশ করিয়াছিল, যে কৌশলে ইমাম হোসেনকে নূরনবী মোহাম্মদের রওজা হইতে বাহির করিয়া কুফায় পাঠাইয়াছিল, তাহা সকলেই শুনিয়াছেন। মহাপ্রান্তর কারবালার ঘটনা যদিও আমরা চক্ষে দেখি নাই কিন্তু মদিনাবাসীদিগের মুখে যে প্রকার শুনিয়াছি তাহা আমার বলিবার শক্তি নাই। যাহা ঈশ্বরের অভিপ্রায় ছিল, হইয়াছে। তাহার পর যে যে ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহা আপনারা স্বচক্ষেই দেখিয়াছেন।
“যেদিন দামেস্ক-প্রান্তরে আমাদের শেষ আশা-মুসলমান জগতের শেষ আশা-ইমাম বংশের একমাত্র রত্ন, পবিত্র সৈয়দ-বংশের একমাত্র অমূল্যনিধি, এই নবীন মহারাজ জয়নাল আবেদীনকে এজিদ শূলে চড়াইয়া প্রাণবধের আজ্ঞা করিয়াছিল, সেদিন এজিদ প্রেরিত সন্ধিপ্রার্থী দূতবরকে যে-যে কথা বলিয়া যুদ্ধে ক্ষান্ত দিয়াছিলাম, মহাশক্তিসম্পন্ন ভগবান আজ আমাদিগকে সেই শুভদিনের মুখ দেখাইলেন, পূর্ব-প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিলেন। কিন্তু আশা মিটিল না, মনোবিকার মন হইতে একেবারে বিদূরিত হইল না, সম্পূর্ণরূপে মনের আনন্দ অনুভব করিতে পারিলাম না। ঈশ্বরের লীলা কে বুঝিবে? সিংহাসনাধিকারের পূর্বে মহারাজ হানিফার তরবারি এজিদ রক্তে র িত হইতে দেখিলাম না। সে মহাপাপীর পাপময় শোণিতবিন্দু মোহাম্মদ হানিফার তরবারি বহিয়া দামেস্ক ধরায় নিপতিত হইতে চক্ষে দেখিলাম না। সে স্বেচ্ছাচারী পরশ্রীকাতর, দামেস্কের কলঙ্ক, মহাত্মা মাবিয়ার মনোবেদনাকারী এজিদ্-শির দামেস্ক প্রান্তরে লুণ্ঠিত হইতে দেখিলাম না। আক্ষেপ রহিয়া গেল। আরো আক্ষেপ এই যে, এই শুভ সময়ে রাজশ্রী মোহাম্মদ হানিফাকে রাজসিংহাসনের পার্শ্বে উপবিষ্ট দেখিলাম না। সময়ে সকলই হইল। কিন্তু সুখসময়ে উপস্থিত দুইটি অভাব রহিয়া গেল। না-জানি বিধাতা ইহার মধ্যে কী আশ্চর্য কৌশল করিয়াছেন! দয়াময় ভগবান কি কৌশল করিয়া কৌশলজাল বিস্তারে আম্বাজ অধিপতিকে কোথায় রাখিয়াছেন, তাহা তিনিই জানেন। যে পর্যন্ত সন্ধান পাইলাম, তাহাতে আশঙ্কার কথা কিছুই নাই। তবে সম্পূর্ণরূপে মনের আনন্দ অনুভব করিতে পারিলাম না। (আনন্দধ্বনি) অনেক শুনিলাম এ জীবনে, অনেক দেখিলাম। আশ্চর্য ঈশ্বর লীলা! ঈশ্বরভক্ত-ঈশ্বরপ্রেমিকদিগের সাংসারিক কার্য কখনোই সর্বাঙ্গীণ-সুন্দর হয় না। তাঁহারা আজীবন কষ্ট-কেশ-যন্ত্রণা ভোগ করিয়া গিয়াছেন। পরিবারগণকেও যে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে রাখিতে পারিয়াছেন, তাহাও দেখিলাম। অনেক অজ্ঞ লোক এই সকল ঘটনায় প্রকাশ্যে কিছু বলিতে না পারিলেও মনে মনে অবশ্যই বলিয়া থাকে যে, ভক্তপ্রেমিকের দশাই এইরূপ।
“পয়গম্বরগণ যে ঈশ্বরের এত ভালবাসা, এত প্রিয়-প্রিয়জন, তাঁহারাও সময় সময় মহাকষ্টে পতিত হইয়া মহাদুঃখ ভোগ করিয়াছেন। প্রিয় বন্ধুগণ! সম্ভ্রান্ত সভ্যগণ! আপনারা বিদিত আছেন,-হজরত নূহকে তুফানে, ইব্রাহিমকে আগুনে, মানবচক্ষে কতই-না কষ্ট পাইতে হইয়াছে!-আর দেখুন! হজরত সোলেমান রাজা ও পয়গম্বর।-রাজা কেমন?-সর্বপ্রাণীর উপর রাজত্ব, সর্বজীবের উপর আধিপত্য ও অধিকার। পরিবার-পরিজন ও সৈন্য-সামন্তসহ সুসজ্জিত সিংহাসন এই জগদ্ব্যাপী বায়ু,-মাথায় করিয়া শূন্যে শূন্যে বহিয়া লইয়া যাইত। সামান্য ইঙ্গিতে দেব-দৈত্য-দানব-পরী যেন সাগরে-জঙ্গলে-পর্বতে কোথায় কে লুকাইত, আর সহজে সন্ধান পাওয়া যাইত না। এমন যে দেব-দৈত্য-দানব-দলন নরকিন্নর পূজিত ভূপতি ও পয়গম্বর, তাঁহাকেও মহাবিপদে পতিত হইতে হইয়াছে। তাঁহার হস্তস্থিত মহাগৌরবান্বিত শক্তিশালী অঙ্গুরীয়ক হারাইয়া চল্লিশ দিবস কি কষ্টই না ভোগ করিয়াছিলেন। বিধির বিধানে এক ধীবরের নিকট মজুরিস্বরূপ দৈনিক দুইটি মৎস্যপ্রাপ্ত হইবেন-নিয়মে চাকরি স্বীকার করিয়া উদরান্নের সংস্থান করিতে হইয়াছিল। চাকরি বাঁচাইতে মৎস্যের বোঝা মাথায় করিয়া বাজারে বিক্রয় করিতে হইয়াছিল। বাধ্য হইয়া দায়ে পড়িয়া ধীবরকন্যা বিবাহ করিতে পশ্চাৎপদ হইতে কি অসম্মতি প্রকাশ করিতে সাধ্য হয় নাই-পারেন না। এত বড় মহাবীর হজরত মোহাম্মদের পিতৃব্য আমীর হামজা। কোরেশ বংশে কেন, সমগ্র আরব দেশে যাঁহার তুল্য বীর আর কেহ ছিল না, সেই মহাবীর হাম্জাকেও একটা সামান্য স্ত্রীলোকহস্তে প্রাণ দিতে হইয়াছিল। পয়গম্বরই হউন, আর মহাবীর গাজীই হউন, উচ্চ মস্তকে, উচ্চগৌরবে নিষ্কলঙ্কে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শুভ্রবসনে এই মায়াময় কুহকিনী ধরণী পৃষ্ঠ হইতে সরিয়া যাইতে কেহই পারে না-ইহাতে মহারাজ হানিফা আমাদের আম্বাজ অধীশ্বর যে অক্ষতশরীরে নিষ্কলঙ্কভাবে সর্বদিকে সুবাতাস বহাইয়া বিজয়নিশান উড়াইয়া বিজয়ডঙ্কা বাজাইয়া জগতে অক্ষুণ্ন কীর্তিস্তম্ভ স্থাপন করিয়া সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে যাইবেন ইহা কখনোই বিশ্বাস হয় না! মহাকৌশলে অদ্বিতীয় ঈশ্বরের এ লীলার অর্থ কে বুঝিবে? এ গুপ্ত রহস্যভেদ কে করিবে? ধার্মিক এবং ঈশ্বর-প্রেমিক জীবনই কী এত কণ্টকময়-সে জীবনের কী এত বিপদ,-এত যন্ত্রণা! অপ্রেমিক অধার্মিক এ জগতে এক প্রকার সুখী। অনেক কার্য সুন্দর মত সর্বাঙ্গীণসুন্দরের সহিত সম্পন্ন করিয়া লয়।