সকলেই সাবধান হইলেন। সংবাদবাহীর অশ্ব যেন বায়ুভরে উড়িয়া সকলের বামপার্শ্ব হইয়া, চক্ষের পলকে গাজী রহমানের নিকট চলিয়া গেল। গাজী রহমানের নিকটস্থ হইয়া অভিবাদনপূর্বক বলিতে লাগিল, “দামেস্কনগরের মধ্য হইতে রণক্ষেত্র পর্যন্ত জীবন্ত জীবের মুখ দেখিতে পাইলাম না। নগর-অভ্যন্তর পথ, রণক্ষেত্রে গমনের পথ এবং অন্য অন্য পথঘাট মৃতদেহে পরিপূর্ণ, গমনে মহাকষ্ট। ধরাশায়ী খণ্ডিত দেহ সকলের সে দৃশ্য দেখিতেও মহাকষ্ট। বহুকষ্টে রণক্ষেত্র পর্যন্ত যাইয়া দেখিলাম, সব শবাকার। খণ্ডিত নরদেহ এবং অশ্বদেহ সকল কতক অল্প রক্ত মাখা, কতক রক্তে প্লাবিত। দেখিলাম, মরুভূমিতে রক্তস্রোত প্রবাহিত। কী ভীষণ রণ! এজিদ্ শিবিরের ভস্মাবশেষ হইতে এখনো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অগ্নিশিখাসহ ধূমরাশি অনবরত গগনে উঠিতেছে। কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইয়াই দেখিলাম যে, একজন ফকির রণক্ষেত্রের মধ্যে খণ্ডিত দেহসকলের নিকটে যাইয়া কি যে দেখিয়া দেখিয়া যাইতেছে, তাহার চলনভঙ্গি, অনুসন্ধানের ভাব দেখিয়া যথার্থ ফকির বলিয়া সন্দেহ হইল। ত্রস্তে ঘোড়া ছুটাইয়া ফকির বেশধারীর নিকট যাইয়াই দেখি যে, আমাদের গুপ্তচর ওসমান, গলায় তসবী, হাতে আশা, গায়ে সবুজ পিরহান। দেখা হইবামাত্র পরিচয়, আদর আহ্লাদ, সম্ভাষণ। তাঁহারই মুখে শুনিলাম, “মহারাজাধিরাজ মোহাম্মদ হানিফা মদিনাধিপতির সহিত দামেস্ক নগরে প্রবেশ করেন নাই। ঘোর যুদ্ধ সময়েই তিনি এজিদের সন্ধান করেন। যুদ্ধজয়ের পরক্ষণেই এজিদ্ তাঁহার চক্ষে পড়ে। এজিদের চক্ষুও চঞ্চল, পশ্চাৎ চাহিতেই দেখে যে, সেই বিস্ফারিত চক্ষুদ্বয় হইতে ঘোর রক্তবর্ণের তেজ সহস্র শিখায় বহির্গত হইতেছে, ঘোড়াটিও রক্তমাখা হইয়া এক প্রকার নূতন বর্ণ ধারণ করিয়াছে, বাম হস্তে অশ্বের বল্গা, দক্ষিণ হস্তে বিদ্যুৎ আভা সংযুক্ত রক্তমাখা সুদীর্ঘ তরবারি, মুখে কই এজিদ্! কই এজিদ্! এজিদ্ আপন নাম শুনিয়া পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিয়াই বুঝিল, আর রক্ষা নাই, এক্ষণে পলায়নই শ্রেয়ঃ। যেই দেখা অমনই যুক্তি-পলায়নই শ্রেয়ঃ। অশ্বে কশাঘাত-অশ্ব ছুটিল। মহারাজও এজিদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ সিংহবিক্রমে দুল্দুল্ ছুটাইলেন। দেখিতে দেখিতে দামেস্ক-প্রান্তর অতিক্রম করিয়া প্রান্তরের পশ্চিম দিকস্থ পর্বত শ্রেণীর নিকটস্থ হইলেন। পশ্চাৎ দিক হইতে তীর মারিলেই এজিদের জীবন লীলা ঐ স্থানেই শেষ হইত। মোহাম্মদ হানিফা একবার এজিদের এত নিকটবর্তী হইয়াছিলেন যে, অসির আঘাত করিলেই এজিদ্-শির তখনই ভূতলে লুণ্ঠিত হইত। পশ্চাদ্দিক হইতে কোন অস্ত্রাঘাত করিবেন না, সম্মুখ হইতে এজিদ্কে আক্রমণ করিবেন, এই আশাতেই বোধ হয় মহাবেগে ঘোড়া ছুটাইলেন। কিন্তু এজিদ্ও এমনভাবে অশ্ব চালাইয়াছিল যে, কিছুতেই মহারাজকে তাহার অগ্রে যাইতে দেয় নাই। দেখিতে দেখিতে আর দেখা গেল না। প্রথম অশ্ব অদর্শন, শেষে আরোহীদ্বয়ের মস্তক পর্যন্ত চক্ষের অগোচর। আর কোন সন্ধান নাই, সংবাদ নাই। কয়েকজন আম্বাজী অশ্বারোহী সৈন্য মহারাজের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিয়াছিল কিন্তু তাহারা অনেক পশ্চাৎ পড়িয়া রহিল। এই শেষ সংবাদ।”
সংবাদবাহী অভিবাদন করিয়া বিদায় হইল। গাজী রহমান আর অপেক্ষা করিলেন না। রাজপুরী মধ্যে অগ্রে পদাতিক সৈন্য প্রবেশের অনুমতি করিলেন। তাহার পর অশ্বারোহী বীরগণ পুরীমধ্যে প্রবেশের অনুমতি পাইলেন। তৎপরে মহারথিগণ এজিদ্পুরীমধ্যে প্রবেশ করিতে অগ্রসর হইলেন। বীরদাপে জয় ঘোষণা করিতে করিতে সকলেই প্রবেশ করিলেন। সে বীরদাপে, জয় রবে রাজপ্রাসাদ কাঁপিতে লাগিল, সিংহাসন টলিল। সে রব দামেস্কের ঘরে ঘরে প্রবেশ করিল।
গাজী রহমান, মস্হাব কাক্কা, ওমর আলী ও অন্যান্য রাজগণ মহারাজাধিরাজ জয়নাল আবেদীনকে ঘিরিয়া “বিসমিল্লাহ্” বলিয়া পুরীমধ্যে প্রবেশ করিলেন। পুরীমধ্যে একটি প্রাণীও তাঁহাদের নয়নগোচর হইল না। সকলই রহিয়াছে, যেখানে যাহা প্রয়োজন, সকলই পড়িয়া রহিয়াছে, এখনই যেন পুরবাসীরা কোথায় চলিয়া গিয়াছে। প্রাঙ্গণে উপস্থিত হইলেন। সেখানেও ঐ ভাব, কেহই নাই। অস্ত্রধারী, অশ্বারোহী, পদাতিক প্রভৃতি যাহা কিছু নয়নগোচর হয়, সকলই তাঁহাদের। ক্রমে তৃতীয় প্রাঙ্গণে উপস্থিত। সেখানেও ঐ কথা। গৃহসামগ্রী যেখানে যেরূপ সাজান, ঠিক তাহাই আছে, কোনরূপ রূপান্তর হয় নাই। এখনই ছাড়িয়া-এখনই তাড়াতাড়ি ফেলিয়া যেন কোথায় চলিয়া গিয়াছে। এইরূপ প্রাসাদের পর প্রাসাদ, কক্ষান্তরে কক্ষ, শেষে অন্তঃপুরমধ্যে প্রবেশ করিলেন। কী আশ্চর্য-সেখানেও সেই ভাব। সকলই আছে,-রাজপুরীমধ্যে যাহা যাহা প্রয়োজন, সকলই রহিয়াছে! কিন্তু তাঁহাদের আপন সৈন্য-সামন্ত ও তুরী-ভেরী নিশানধারিগণ ব্যতীত অন্য কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। কক্ষে কক্ষে সন্ধান করিয়াও জন প্রাণীরও দেখা পাইলেন না। ভাবে বোধ হইল, যেন কোন গুপ্ত স্থানে লুকাইয়া রহিয়াছে। কোথায় যে গুপ্ত স্থান? তাহার কোন সন্ধান করিতে পারিলেন না। জয়ের পর-যুদ্ধ জয়ের পর, বিপক্ষ রাজপুরী প্রবেশের পর,-রাজপ্রাসাদ অধিকারের পর যাহা হইয়া থাকে, তাহা হইতে আরম্ভ হইল। দুই হস্তে লুট। প্রথম সৈন্যগণের লুট, যে যাহা পাইল সে তাহা আপন অধিকারে আনিল। কত গুপ্ত গৃহের কপাট ভগ্ন হইতেছে; হীরা, মতি, মণি, কাঞ্চন, কত রাজবসন, কত মণিমুক্তাখচিত আভরণ, রাজ ব্যবহার্য দ্রব্য যাহার হস্তে যাহা পড়িতেছে লইতেছে। আর যাহা নিষ্প্রয়োজন মনে করিতেছে, ভাঙ্গিয়া ছারখার করিতেছে।