“ঈশ্বর মহান্, তাঁহার কার্যও মহৎ। কোন্ সূত্রে কোন্ সময়ে কাহার প্রতি তিনি কি ব্যবস্থা করেন, তাহা তিনিই জানেন। মদিনার বীরশ্রেষ্ঠ কাসেমের শোক কি আমরা ভুলিয়াছি? প্রভু হোসেনের কথা কি আমাদের মনে নাই! প্রভু-পরিবার এখনো বন্দিখানায়। নূরনবী মোহাম্মদের প্রাণতুল্য প্রিয় পরিজন এখনো এজিদের বন্দিখানায় কয়েদ-এ কী শুনিবার কথা! না-চক্ষে দেখিবার কথা। মার কাফের, জ্বালাও নগর-আসুন আমাদের সঙ্গে।”
এই সকল কথা কহিয়া নগরের পথে পথে, দলে দলে, মার মার শব্দে হানিফার সৈন্যগণ ছুটিল। গাজী রহমান, মস্হাব কাক্কা প্রভৃতি জয়নাল আবেদীনকে লইয়া প্রকাশ্য রাজপথে চলিয়াছেন। রাজপুরী নিকটবর্তী, বন্দিগৃহ কিছুদূরে! গাজী রহমানের আজ্ঞায় গমনবেগ ক্ষান্ত হইল। সঙ্কেত-চিহ্ন সমুদয় সৈন্য দামেস্ক-রাজপথে, যে যে পদে, যে ভাবে দাঁড়াইয়াছিল, সে সে পদ সে স্থানেই রাখিল। কি সংবাদ? ব্যস্ত হইয়া সকলেই জয়নাল আবেদীনের চন্দ্রাতপোপরিস্থ পতাকা প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলেন। কোনরূপ বিরূপ বা বিপর্যয় ভাব দেখিলেন না, জাতীয় নিশান হেলিয়া-দুলিয়া গৌরবের সহিত শূন্যে উড়িতেছে। জয়বাজনা সমভাবে বাজিতেছে। গাজী রহমান অশ্বপৃষ্ঠে থাকিয়াই মস্হাব কাক্কা, ওমর আলী এবং আক্কেল আলীর সহিত কথা কহিতেছেন। অশ্বসকল গ্রীবাবক্রে স্থিরভাবে দণ্ডায়মান-কিন্তু সময়ে সময়ে পুচ্ছগুচ্ছ হেলাইয়া ঘুরাইয়া কর্ণদ্বয় খাড়া করিয়া স্বাভাবিক চঞ্চলতা ও তেজ ভাবের পরিচয় দিতেছে।
গাজী রহমান বলিলেন, “রাজপুরী নিকটবর্তী, বাদশা নামদারের কোন সংবাদ পাইতেছি না।”
মস্হাব কাক্কা বলিলেন, “গুপ্তচর সন্ধানিগণ যুদ্ধক্ষেত্রেই আছে। এ পর্যন্ত সংবাদ নাই, এ কী কথা! কারণ কী?”
“যুদ্ধাবসানে, কি বিজয়ের শেষ মুহূর্তে, আপন সৈন্যসামন্ত, ভারবাহী, সংবাদবাহী, প্রধান প্রধান যোধ এবং সেনানায়কগণের প্রতি বিশেষ মনোযোগ রাখিতে হয়। বিজয় আনন্দে কে-কোথায়-কাহার পশ্চাতে মার মার শব্দে মাতোয়ারা হইয়া ছুটিতে থাকে, কিছুই জ্ঞান থাকে না। সে সময় বড়ই সতর্ক ও সাবধান হইয়া চলিতে হয়। আপন দলবল ছাড়িয়া কে-কাহার পশ্চাৎ কতদূর তাড়াইয়া যায়, সে জ্ঞান প্রায় কাহারো থাকে না। এই অবস্থায় যুদ্ধ-জয়ের পরেও অনেক জেতা সামান্য হস্তে প্রাণ হারাইয়াছে। ইহার বহুতর দৃষ্টান্ত আছে। পলায়িত শত্রুগণ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হইয়া কে-কোথায় লুকাইয়া থাকে; কে বলিতে পারে? এজিদের সৈন্য বলিতে একটি প্রাণীও আর যুদ্ধক্ষেত্রে নাই। তবে মোহাম্মদ হানিফা কোথায় রহিলেন? এজিদের কোন সংবাদ পাওয়া যায় নাই। বিপক্ষ দলের কোন সংবাদ এ পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই। তবে এটা নিশ্চয় কথা যে, বিপক্ষদলের সংবাদ শূন্য। মোহাম্মদ হানিফা কোথায়, আমার সেই চিন্তাই এইক্ষণ অধিকতর হইল। অশ্বারোহী সন্ধানী পাঠাইলে এখনই সংবাদ আনিবে। আমরা রাজপুরী পর্যন্ত যাইতে যাইতে যুদ্ধ স্থানের সংবাদ অবশ্যই পাইব-আশা করি।”
আদেশমাত্র সন্ধানী দূতের অশ্ব ছুটিল। শুভ্র-নিশানের অগ্রভাগ আরোহীর মস্তকোপরি বায়ুর সহিত ক্রীড়া করিতে লাগিল।
গাজী রহমান পুনরায় মস্হাব কাক্কাকে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন, “নগরে প্রবেশ সময় পৃথক্ পৃথক্ পথে সৈন্যদলকে প্রবেশ করিতে অনুমতি দেওয়া হইয়াছে। যে দিক হইতে যে দল রাজভবন পর্যন্ত যাইবে, সে দিক রক্ষার ভার তাহাদের উপর থাকিবে। যে পর্যন্ত পুরীমধ্যে দীন মোহাম্মদী নিশান উড়িতে না দেখিবে, জয়নাল আবেদীনের বিজয় ঘোষণা যতক্ষণ পর্যন্ত কর্ণে না শুনিবে, সে পর্যন্ত কোন দলই পুরীমধ্যে প্রবেশ করিতে পারিবে না। মোহাম্মদ হানিফার সংবাদ না জানিয়া এজিদ্-পুরীতে প্রবেশ করিতে ইচ্ছা হইতেছে না।”
“ভালই, সংবাদ না জানিয়া এজিদ্-পুরীতে যাইব না। ভাল কথা, এই অবসরে বন্দিগণকে উদ্ধার করিলে ক্ষতি কি?”
“না, না, তাহা হইতে পারে না। অগ্রে মহারাজের সংবাদ, তাহার পর পুরী-প্রবেশ। পুরী-প্রবেশ করিয়াই সর্বাগ্রে রাজসিংহাসনের মর্যাদা রক্ষা; পরে বন্দিমোচন।”
“তবে ক্রমে অগ্রসর হওয়া যাক। ঐ আমাদের সৈন্যগণের জয়ধ্বনি শুনা যাইতেছে। যাহারা ভিন্ন ভিন্ন পথে গিয়াছিল, তাহারা শীঘ্রই আমাদের সহিত একত্র মিশিবে।”
আবার সঙ্কেতসূচক বাঁশি বাজিয়া উঠিল। মহারাজ জয়নাল আবেদীনের চন্দ্রাতপ-সংযুক্ত জাতীয় নিশান হেলিয়া-দুলিয়া চলিতে লাগিল। “জয়-মহারাজ জয়নাল আবেদীনের জয়!” সৈন্যগণের মুখে বারবার উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারিত হইতে লাগিল। রাজপথে অন্য লোকের গতিবিধি নাই। এজিদ্ পক্ষের জনপ্রাণীর নামমাত্র নগরে নাই। সুন্দর সুন্দর বাড়ি-ঘর সকল শূন্য হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে।
কিছু দূর যাইতেই দামেস্ক-রাজপুরীর সুরক্ষিত অত্যুচ্চ প্রবেশদ্বার সকলের নয়নগোচর হইল। এত সৈন্য, এত অশ্ব, এত উষ্ট্র, এত নিশান, এত ডঙ্কা, এত কাড়া রাজপথ জুড়িয়া হুলস্থূল ব্যাপারে যাইতেছে। ঐ সকল কোলাহল ভেদ করিয়া দ্রুতগতি অশ্ব সঞ্চালনের তড়াক তড়াক পদশব্দ সকলেরই কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল। কিন্তু গাজী রহমানের আজ্ঞা ব্যতীত-বলিতে কী, একটা মক্ষিকা উড়িয়া বসিবার ক্ষমতা নাই। কার সাধ্য, স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখে? কাহার সাধ্য, তাহার সন্ধান লয়?-কে সে লোক, পরিচয় জিজ্ঞাসা করে?
মনের কথা মন হইতে সরিতে-না-সরিতেই বাঁশির স্বরে কয়েকটি কথা কর্ণে প্রবেশ করিল-“আম্বাজী সংবাদবাহী যুদ্ধক্ষেত্র হইতে সংবাদ লইয়া আসিতেছে। রাস্তা পরিষ্কার।” দ্বিতীয়বার বাঁশি বাজিল, শব্দ হইল, “সাবধান!”