শেষ রাত্রে ঘুম ভেঙে গেলে ঈশ্বর উসখুস করতে করতে একবার বাইরে থেকে ঘুরে এসে আলো জ্বালে। গৌরী জেগে গিয়েছিল, গাঢ় ঘুমের ভান করে সে মটকা মেরে পড়ে থাকে।
দেখাই যাক ঈশ্বর কি করে।
আলো জ্বালাবার মানেটা তার মাথায় ঢোকে না। আর কাঠের তক্তপোশে পিসি আর শাশুড়ি শুয়েছে। কানে যতই কম শুনুক, একটা চোখে ছানি পড়তে শুরু হোক, অন্য চোখে নজর আছে বেশ। আলো জেলে রেখে তাকে ডেকে কৈফিয়ত দিয়ে মাফ চেয়ে মিটমাট করে নেবার চেষ্টা তো সে করতে পারবে না!
গোসা হলে শুধু মিষ্টি মিষ্টি নরম কথায় যে তার মানের চিড়ে ভেজে না, গায়ে হাত দিতে গেলেই গোড়ায় খানিকক্ষণ সে ফাঁসফাঁস করে উঠলেও শেষ পর্যন্ত বেশ খানিকটা আদরও তাকে করতে হয় এটা নিশ্চয় ঈশ্বর ভুলে যায় নি? অথবা এখনো নেশা কাটে নি ঈশ্বরের? সুখে বলেছিল, কাল অনেক বেশি গিলেছে। বেশি খেলে এক রাতের ঘুমে হয়তো ঘোর কাটে না, কে জানে!
গৌরী কাত হয়ে শুয়েছিল, ঈশ্বর আলো জ্বলে কি করছে দেখার সাধটা প্ৰাণপণে চেপে চোখ বুজে রেখেছিল। কারণ তাকে চোখ মেলতে দেখে ফেললে ঈশ্বর টের পেয়ে যাবে সে জেগে গিয়েছে।
অপরাধ করার জন্য ভয়ে ভয়ে মৃদু মোলায়েম আদর খাঁটিয়ে খাঁটিয়ে তার ঘুম ভাঙাবার চেষ্টা আর করবে না।
হয়তো কোনো একটা হুকুম দিয়েই বসবে।
খেয়ালি মানুষ, ওকে বিশ্বাস নেই।
ঈশ্বর হঠাৎ কাতরভাবে আওয়াজ করে ওঠে, উঃ রে বাবারে, গেলাম রে, মরলাম রে!
বুকটা ধড়াস করে ওঠে গৌরীর।
সে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে।
আলো জ্বলে এতক্ষণ ঈশ্বর কি করছিল কে জানে, দুহাতে মাথা চেপে ধরে মেঝেতে উবু হয়ে বসে এখন সে সামনে পিছনে দুলছে।
হল কি? বেশ তো নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিলে নেশার ঘোরে?
কি সব খাইয়ে দিলে সুখে কাল, বিষম যন্ত্রণা হচ্ছে। যত বলি আর খাব না, এসব মোর সয় না, তত বেশি জবরদস্তি খাওয়ায়। সায়েবের পেয়ারের লোক, ইচ্ছে করলে কাজ খতম করে দিতে পারে।
গৌরী বলে, জানি জানি, সব মোর জানা আছে। ডেকে নিয়ে জোর করে গিলিয়েছে, সে খবরটা রাখি। কি রকম যন্ত্রণা হচ্ছে গো? তোমার যদুদা বংশী খুড়োদের ডেকে আনব, পিসিকে সাথে নিয়ে?
ওরা এসে কি করবে? সুখে কি খাইয়েছে, ওরা কি খবর জানে? ইস, যদি একবার খেয়াল হত বজ্জাতটা এমনিভাবে খাতির করে আমায় ঘায়েল করতে চায় কথা শেষ করতে পারে না, পরপর কয়েকটা হিব্ধা তুলে ঈশ্বর চুপ করে যায়।
মনে একটু খটকা লাগে গৌরীর। বিষম যন্ত্রণায় যার প্রাণ যাচ্ছে, বাবা রে মা রে বলে কাতরাচ্ছে–সে কি লাগসই কৈফিয়তের অত কথা বলতে চায়, না বলতে পারে?
ঈশ্বর কি জানে না যে, হাজার চড়া গোঁসা হলেও এরকম অবস্থায় আগে সে তাকে সুস্থ করার জন্য প্রাণপাত করবে, মানভঞ্জনের পালা নিজেই সে শিকেয় তুলে রাখবে?
তবে এটাও ভাববার কথা, আজ পর্যন্ত ঈশ্বর কোনোদিন তার সঙ্গে এরকম প্যাচ কষে নি। ওটা তার ধাতে আছে কিনা সন্দেহ।
গৌরী তাই সব হিসাব নিকাশ ভুলে যায়। উঠে গিয়ে ব্যাকুলভাবে বলে, মাথায় জল দেব?
তাই বরং দে।
মেটে কলসী থেকে ঠাণ্ডা জল অন্য পাত্রে গড়িয়ে আনে না গৌরী, কলসীটাই নিয়ে আসে।
এখন কি আর পুরোনো একটা মাটির কলসীর জন্য মায়া করার সময়! অবশ্য কলসীটা ভেঙেচুরে গেলে আরেকটা মাটির কলসী আনতে বিলম্ব হবে, কয়েকদিন ঘরে তার জলের কষ্টের সীমা থাকবে না।
কলসীর মুখ-ঢাকা মাটির সরায় জল ঢেলে ঢেলে গৌরী স্বামীর মাথা ধুইয়ে দিতে থাকে। সযত্নে সাবধানে জল ঢালে, গা যেন না ভিজে যায়।
হঠাৎ হড়হড় করে একগাদা বমি করে ফেলে ঈশ্বর।
গৌরীর হাত থেকে মাটির সরাটা কেড়ে নিয়ে কলসীর তলানি জলটুকু গড়িয়ে নিয়ে এক নিশ্বাসে খালি করে বলে, বাবাঃ, বাঁচলাম।
যশোদা কখন প্ৰাচীন আম কাঠের তক্তপোশ থেকে উঠে এসে পিছনে দাঁড়িয়েছিল তারা টের পায় নি।
বুড়ি শাশুড়ির এইসব চালচলন গৌরীর কাছে উদ্ভট লাগে। মানুষটাকে খাইয়ে দিতে হয়, প্রায় কোলে করে বাইরে নিতে হয়। এপাশ ওপাশ ফিরিয়ে দেবার জন্যও মাঝে মাঝে তাকে দরকার হয়—কটি শিশুর মতত ক্ষীণস্বরে এমন ভাবে কাঁদে!
অথচ মাঝে মাঝে নিজেই আম কাঠের বিছানা ছেড়ে বিনা সাহায্যে উঠে আসতে পারে।
তাদের একটি কথা বা আওয়াজও যশোদা শুনতে পায় নি। বমি করে জল খেয়ে মেঝেতে বিছানো চাটাই চট আর কথার বিছানার কোণে বসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ঈশ্বর পেট্রোল লাইটার দিয়ে বিড়ি ধরিয়ে টানতে শুরু করলে যশোদা চড়া খ্যানথেনে গলায় বলে, মদ খেয়েছিলি, না রে বাবা? ফুলুড়ি, বেগুনি, পেঁয়াজী খেয়েছিলি পেট পুরে?
নিজের কান দুটিতে শব্দের খেলা শেষ হয়ে গিয়েছে যশোদা এমন চেঁচিয়ে কথা বলে যে, পাড়ায় কেন, অনেক দূরের থানায়ও বুঝি শোনা যায়।
ধমক দিয়ে লাভ নেই। শুনতেই পাবে না।
মুখটা গম্ভীর বিকৃত করে, ঠোঁটে আঙুল চাপা দিয়ে ইশারা করে ঈশ্বর মাকে হুকুম দেবার চেষ্টা করে–চুপ কর।
যশোদা গ্রাহ্য করে না।
মাথা ভরা শণের মতো পাকা চুল। তাতে বুঝি উকুনেরা দলে দলে বাসা বেঁধেছে। মাথা। চুলকোতে চুলকোতে যশোদা তেমনি চড়া খ্যানখেনে গলায় বলে, মোকে কেন ডাকলিনে বাবা? এত কষ্ট সইতে হত না। ঘি নয়তো তেল দিয়ে চিনি একটু খাইয়ে দিতাম, নুন গলে না এমন এক পিত্তর জল দিতাম। বাস্, ফুরিয়ে যেত। বমিও করতি, কষ্ট কমে গিয়ে রাতভোর ঘুমোতি নাক ডাকিয়ে।
ঈশ্বর উঠে গিয়ে দুহাত মুঠো করে মাথার উপর তুলে ধরে সর্বাঙ্গ শক্ত করে বিশেষ একটা বীভৎস ভঙ্গি করে যোদর সামনে মুখোমুখি দাঁড়ায়।