ঈশ্বর গুম খেয়ে বলে, দোষটা কি? সঁচজনা পিঠ না চাপড়ালেই কি আসল কিছু এসত?
সুখে হেসে বলে, আসতে পারে তো? কার অদেষ্টে কিভাবে ধনলাভ আছে কে জানে বল! ভগৃমান ব্যাটা যাকে দ্যা চাল ফুটো করে দ্যা। তা বলছিলাম কি, বাঘ-মারা বীর হতে না চাইলে যদি পকেটে কিছু আসে তাতে আপত্তি আছে? নগদ নগদ কড়কড়ে টাকা পেলে?
কি বকছ নেশার ঝোঁকে? আর খেয়ে নি।
সুখে হেসে বলে, হাঃ, দাদা তুমি হাসালে! বিশ বছর নেশা করছি, দু নম্বর এটুকু খেয়ে নেশার কেঁকে বকব!
পকেট থেকে কয়েকটা ভাঁজ করা দশ টাকার নোট বার করে দেখায়। কটা নোট কে জানে। নিচু গলায় ব্যাখা করে বুঝিয়ে দেয় ব্যাপারটা।
সায়েব বাঘটা মারার কৃতিত্ব চায়, সেজন্য নগদ দাম দিতেও সে প্রস্তুত। ঈশ্বরের জোর গলায় দাবি করার কি দরকার যে, তার দেশী বন্দুকের গুলিতেই বাঘটা মরেছিল?
ওটা সে অস্বীকার করুক। বলুক যে সায়েব বাঘটাকে মেরেছে। এই ঘোষণাযুক্ত একটা কাগজে শুধু একটা টিপ সই দিয়ে দিক সুখে এখুনি তাকে কড়কড়ে নগদ টাকার নোট কটা দিয়ে দেবে।
কত টাকার নোট?
সায়েব দিলদরিয়া লোক। একদম পঞ্চাশ টাকা দিয়েছে। ভাগ্যিমান মানুষ বটে বাবা, একটা বাঘ তুমি মার নি, সায়েব মেরেছে বলার জন্য নগদ পঞ্চাশটা টাকা!
ঈশ্বর মাথা নাড়ে, পঞ্চাশ টাকায় হয় না।
কত হলে হয়?
শ আড়াই।
সায়েব রাজি হবে না।
আমিও রাজি হব না। আড়াই শ থেকে দশ-বিশ টাকা তুমি পাবে। সায়েব হয়তো পাঁচ শ টাকা কবুল করেছে, তুমি আমার ঘাড়টা ভাঙছ কিনা কে জানে!
এতক্ষণ বিড়িই টানছিল, এবার সুখে সস্তা সিগারেটের প্যাকেট বার করে তাকে একটা দেয়, নিজেও একটা ধায়। প্রায় যেন সস্নেহে বলে, টের পেলাম এসব খাওয়া সত্যি তোমার অভ্যেস নেই। মাথায় চড়ে গিয়েছে। এত বোকা ভাবছ সাহেবকে? একটা বাঘ মেরেছে বলতে পারার জন্য পাঁচ শ টাকা কবুল করবে?
ঈশ্বর পাকা নেশাখোরের মতো একচুমুকে ভাড় খালি করে বলে, তবে আমিও রাজি নই। সায়েব পাঁচ শ না সাত শ কবুল করেছে তুমিই জান–সায়েবের এটা মানইজ্জতের ব্যাপার বুঝি না ভাবছ নাকি? তুমি তলে তলে দু-চার শ বাগিয়ে নাও আপত্তি করব না। আড়াই শ আমায় দিতেই হবে।
সুখে নিজের ভাড়ে চুমুক দিয়ে আপন মনে বেশ খানিকক্ষণ চিন্তা করে। তারপরে বলে, বিশ টাকা কমিশনের কথা বলেছিলে। ওটা পঞ্চাশ করে দাও–দুশ নগদ গুনে দিচ্ছি।
ঈশ্বর বলে, নিজের হিসাবে বিশের বেশি পারব না। বেশিটা তুমিই বাগালে–উপায় কি! ছোটর ভাগে আর বেশি থাবা মের না দাদা, মের না। সহ্যের একটা সীমা আছে তো!
ওদিকে গভীর বিরাট বন। এপাশে চওড়া ঘোলাটে হলদে নদী। তার এপাশে জঙ্গল সাফ করা জমিতে ক্লাব হোটেল পান্থশালা বাজার দোকানপাট।
সুখে যেন গ্রাহ্য করে না। এই প্রকাশ্য পরিবেশে সে পঁচিশটা টাটকা দশ টাকার নোট ঈশ্বরকে গুনে দেয়। টের পাওয়া যায় পকেটে তার আরো নোট আছে। ঈশ্বর ভাবে, কে জানে মাঝখান থেকে সুখে কত টাকা বাগিয়ে নিল। ঈশ্বর দুটো নোট ফিরিয়ে দিলে সে দুটো সুখে একান্ত অবহেলার সঙ্গে শার্টের বুক পকেটে খুঁজে দেয়।
০৪. ঈশ্বর ডাকে
ঈশ্বর ডাকে, অ গৌরী, গৌরী?
বিছানায় চিৎ হয়ে পড়ে থেকে চোখ বুজে এরকম বৈরাগ্যমধুর শান্ত উদার গলায় মাঝে মাঝে ঈশ্বর তাকে ডাকে–ম্যালেরিয়া জঁকিয়ে আসার পর। জ্বর যখন অনেক দামি নেশার চেয়েও মজাদার উদ্ভট এলোমেলো বিকারের অবস্থায় তাকে টেনে নিয়ে যায়।
মনটা বিগড়ে যায় গৌরীর। ম্যালেরিয়া তো চুপি চুপি আসে না, কমপক্ষে কাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে কথাকণি-হেঁড়া কম্বল গায়ে চাপানের হাঙ্গামা নিয়ে আসে।
ঈশ্বর তো সারাদিন বাইরে কাটিয়ে বাইরে পেট ভরিয়ে খেয়ে খানিক রাতে ঘরে এসে শুয়েছে।
ডাক শুনে ঘরে গিয়ে বলে, কি বলছ?
ঈশ্বর সাড়াশব্দ দেয় না।
কপালে তালু রেখে গৌরী টের পায়, জ্বরের নামগন্ধও নেই। গা বরং বেশ ঠাণ্ডা।
নিশ্বাসে কি বিশ্ৰী বদ গন্ধ!
গন্ধটা কিসের খেয়াল করে তড়িতাহতার মতো ছিটকে দু পা পিছিয়ে গিয়ে কপাল চাপড়ে কেঁদে উঠতে যাবে এমন সময় বাইরে গম্ভীর পুরুষালি গলার আওয়াজে ডাক আসে, ঈশ্বর, ঘরে আছ নাকি হে ঈশ্বর?
কপাট গৌরী খোলে না। কান্না চেপে গলা সাফ করে চড়া গলায় শুধোয়, কে ডাকছ? মানুষটার জ্বর এসেছে, ঘুমিয়েছে।
ঘুমিয়েছে? বাঁচা গেল বাবা। অভ্যেস নেই, একধারসে চালিয়েছে। খানা ডোবায় পড়ে মরে নি বাপের ভাগ্যি! কী গুখুরি করেছিলাম ওটাকে মাল খেতে ডেকে নিয়ে গিয়ে। খানা ডোবায় মরলে সবাই মোকে দুষত।
সুখের গলার আওয়াজ। একটু জড়ানো অস্বাভাবিক আওয়াজ। জানা চেনা আছে, ঈশ্বর ঘরে আছে, পিসি ঘরে আছে, একেবারে অথর্ব হয়ে মরণ-দশায় পৌঁছালেও জ্যান্ত শাশুড়িটা ঘরে আছে। –কপাট খুলে ঘরে ডেকে বসালে কোনো দোষ হয় না।
কপট গৌরী খোলে না।
খুপরির মতো জানালার ফাঁকে মুখ রেখে বলে, কিছুই তো বুঝতে পারলাম না। তুমি ডেকে নিয়ে গিয়ে মানুষটার এই দশা করে ছেড়েছ?
সুখে নেশার কেঁকে দিশে হারিয়ে ব্যাকুলভাবে বলে, না না, তা নয়, তা নয়। দরজাটা খোল, ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি।
যাকে নিয়ে ব্যাপার, তাকেই কাল বুঝিয়ে বোলো।–বলে গৌরী সরে যায়।
স্বস্তিবোধের তার সীমা ছিল না।
নেশায় প্রায় অচেতন ঈশ্বরের নিশ্বাসে যে পদার্থের দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে সেটা সে নিজে থেকে ইচ্ছা করে গেলে নি, ইয়ারদের পাল্লায় পড়েও গেলে নি। সুখে এর জন্য দায়ী, এটা জানা যেন দেবতার আশীর্বাদের মতো মনে হয়।