শাড়ি পরে। স্বামীর সঙ্গে ছাড়া কোনো নেমন্তনো যায় না, হোটেলে ঢোকে না।
বছর তিনেক আগে রবার্টসন হঠাৎ একটি তরুণী অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছিল।
মেয়েটি ছিল জনসনের টাইপিস্ট।
ইভা সত্যিই রূপসী। যেমন মুখের ছাদ, তেমনি ছিমছাম গড়ন। অনেকেই ভেবেছিল, মাঝবয়সী মাতাল রবার্টসনকে সে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে সেই চিরন্তন হিসাব কষেই যে, আরাম বিলাসের জন্য যেমন হোক একটা মানুষ হাতে ধরা থাকলে পছন্দসই তরুণের সাথে প্রেমের লীলা চালিয়ে যাওয়ার সুবিধা বাড়ে।
দু-একটা বিশ্রী কেলেঙ্কারি যে ঘটবে তাতে সন্দেহ ছিল না। কিন্তু তাদের সকলের হিসাব নিকাশ ভুল প্রমাণ করে ইভা দেখিয়ে এসেছে যে, একুশ বছর বয়সে তেতাল্লিশ বছরের একজন মাতালকে বিয়ে করলেও এবং গা বাঁচিয়ে কয়েকজন জোয়ানের লীলা খেলার মজা লুটবার সুযোগ থাকলেও, সে বিবাহিতা স্ত্রীলোকের সতীত্ব-ধর্মে একান্তভাবেই নিষ্ঠাবতী।
রূপযৌবনের যে মূল্য পেয়েছে তাতেই সে সন্তুষ্ট!
রবার্টসন বাঘ মেরে আনবে–তবু সেদিন কেন সে ক্লাবে যায় নি? এটা তো স্বামীর প্রতি হৃদয়গত বা নীতিগত আনুগত্যের প্রমাণ নয়!
দেহটা সেদিন কাবু হয়ে পড়েছিল ইভার।
লক্ষ্মণের দাওয়ায় বসে রবার্টসনেরা ওদিকে প্রতীক্ষা করছিল ভোর রাত্রে মেরে রেখে যাওয়া গরুটার টানে বাঘটার কখন শুভাগমন ঘটবে। এদিকে ইভা বিছানায় আছড়ে পিছড়ে কোকাতে কোকাতে ছটফট করছিল।
বেদনানাশক বড়ি ডবল ডোজে খাওয়ার পরেও দেড়ঘণ্টা পর্যন্ত।
প্রতি মাসের প্রাকৃতিক ঘটনা।
রবার্টসন ইতিমধ্যেই চিকিৎসার জন্য হাজার কয়েক টাকা খরচ করেছে।
বড় বড় ডাক্তার দেখিয়ে এত চিকিৎসার কোনো ফল হয় না দেখে তার মধ্যে বিরাগ ও বিতৃষ্ণার ভাব জাগছে টের পেয়ে ইভা গত কয়েক মাস থেকে তাকে বলে আসছে যে, সে আশ্চর্যরকম আরোগ্য লাভ করছে।
রোগ আর নেই বললেই হয়।
রবার্টসন চুটিয়ে কাজ করে। সে দু ঘন্টা দেরি করে কাজে গেলে, দু ঘন্টা আগে বেরিয়ে এলে, প্রশ্ন করার অন্য কেউ নেই। সবই তার খুশির ব্যাপার।
সে অবশ্য জানে যে, দু-চার দিন এরকম খেয়ালখুশির ব্যাপার চালিয়ে গেলে কিছুই আসবে যাবে না, কিন্তু এটাকে নিয়মে পরিণত করলে, কাজ করতে স্বাধীনভাবে যেমন খুশি অনিয়ম দু-চারটা মাস চালিয়ে গেলে, হঠাৎ একদিন তাকে প্রস্তুত হতে হবে অনেক দূরে এবং অনেক উপরে বসে আসলে যারা সবকিছু চালাচ্ছে তাদের কাছে কৈফিয়ত দেবার জন্যে। ওরা সব খবর পায়!
তার কৈফিয়ত গ্ৰহণযোগ্য কিনা সেটাও বিচার করবে ওরাই।
এফিসিয়েন্সির প্রশ্নে, ঠিকমতো কাজ চালিয়ে গিয়ে মুনাফা বাড়াতে না পারলেও অন্তত সেটা বজায় রেখে কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে, কোনোরকম কৈফিয়তের কিছুমাত্র দাম নেই ওদের কাছে।
কাজ নিয়ে, ক্লাব নিয়ে, শিকার-টিকারের ব্যাপার নিয়ে রবার্টসন সকাল থেকে অনেক রাত্রি পর্যন্ত বাইরে কাটায়।
ইভার পক্ষে জানিয়ে দেওয়া তাই সম্ভব হয়েছে যে, সে আর প্রতি মাসে বিছানা নেয় না, ব্যথায় কাতর হয়ে ছটফট করে না।
বাঘ শিকারের সব কাহিনীই ইভা সবিস্তারে শোনে মাঝরাত্রে ক্লাবে প্রভাস ও রবার্টসনের মারামারির কাহিনী পর্যন্ত।
বনানীর নিজে এসে প্রভাসকে সামলে-সুমলে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবার বিবরণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করে জেনে নেয়।
সকালে খাবার টেবিলে বসে রবার্টসনের প্রশ্নের জবাবে একটু রাগের ভান করে বলে, তোমার বড় বাড়াবাড়ি। অত খুঁটিনাটি জেনে তোমার কোনো দরকার নেই। মুখ শুকনো দেখাচ্ছে? জগৎসুদ্ধ মেয়েদের মুখ এ সময় শুকনো দেখায়।
সরি।
কয়েক মিনিট সাধারণ কথাবার্তা চালিয়ে যাবার পর ইভা জিজ্ঞাসা করে, বারটার পর গাড়িটা ঘণ্টাখানেকের জন্য পাঠাতে পারবে না? একটু ঘুরে আসব। দম যেন আটকে আসছে।
এই শরীর নিয়ে ঘুরতে যাবে?
আমার শরীর ঠিক আছে।
বারটা বেজে পাঁচ মিনিটের সময় দুলাল সিং গাড়িটা হাঁকিয়ে এনে গেটের সামনে দাঁড় করিয়ে মেমসাবকে সেলাম পাঠায়।
মিনিট পাঁচেক পরেই ইভা বেরিয়ে এসে জানায় যে, গাড়ি সে নিজেই চালিয়ে নিয়ে যাবে, একটা দেড়টার মধ্যে ফিরে আসবে।
দুলাল সিং বলে, বহুৎ আচ্ছা হুজুর।
চালকের আসনে বসে ইঞ্জিনে স্টার্ট দিয়ে গিয়ার বদলাতে গিয়ে ইভার বোধহয় খেয়াল হয়। যে, সে আজ তার বিবাহিত জীবনের এতদিনের নিয়মনীতি ভঙ্গ করছে।
মোটর হাকিয়ে এক বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে দেড় ঘণ্টা-দু ঘন্টার জন্য।
দুলাল সিংহ?
হুজুর?
ভিতরমে বৈঠো।
দুলাল সিংকে পিছনের সিটে বসিয়ে নিজে মোটর হাঁকিয়ে ইভা প্রভাসের প্রকাণ্ড বাগানওলা বাড়ির গেটে হাজির হয়।
নিয়মনীতি মানে না। সোজাসুজি জুতো পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় বনানীর রান্নাঘরের দরজায়।
বনানী স্নান সেরে গায়ে শুধু একটি শাড়ি জড়িয়ে মেঝেতে বসে তিতোর ডাল দিয়ে মাখা ভাতের গ্রাসটা সবে মুখে তুলছিল।
ইভা বলে, উঠ না ভাই, খাও। তুমি উঠলেই কিন্তু আমি চলে যাব, ওয়েট করব না।
পরিষ্কার বাংলা কথা। ছেলেবেলা থেকে সে বাঙালি পাড়ায় বাস করেছে, বাঙালি ছেলেমেয়ের সঙ্গে মিলেমিশে বড় হয়েছে।
তাই কি হয়? তুমি এসে দাঁড়িয়ে থাকবে–
আমি যদি বলি তোমার পাশে গিয়ে বসব, তোমার সঙ্গে বসে মাছ তরকারি দিয়ে ভাত খাব?–বলতে বলতে জুতো খুলে ঘরে ঢুকে ইভা বনানীর পাশে মেঝেতে বসে পড়েছিল।
তোমাদের কুলোবে তো? ওদের কম পড়বে না?
বনানী হেসে বলেছিল, তুমি জান না, তুমি বুঝবে না। কম পড়তেই পারে না। এ বাড়িতে কি নিয়মে রান্না হয় জান? ডিনারের সময় হঠাৎ দশজন আত্মীয়স্বজন হাজির হলে যেন বলতে পারি, নাইতে যান, খেতে আসুন।