পয়সা-কড়ি কিছু বোধহয় বাগিয়ে টাগিয়ে এসেছে গৌরী বাপের বাড়ি বোনের বিয়েতে নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে–দুপুরে গায়ে ফিরে বিকালেই সে শঙ্কর ডাক্তারকে ঘরে ডেকে পাঠায়।
নগদ আগাম এক টাকা দক্ষিণা দিয়ে।
দেড় টাকা দিয়ে স্বচ্ছ শিশিতে ছ দাগ লালিম কুইনিন মিকারও আনায়।
শঙ্কর ছিল গাঁয়ের সেরা লম্পট আর বিবাণী বদ ছেলে। তার পিছনে অবশ্য ছিল বয়স্ক একজন বজ্জাত। তার একটা বজ্রাতিতে জড়িয়ে পড়ে শঙ্কর দু মাস জেলে গিয়েছিল। জেলে কয়েকটা অসুখে ভুগে মোটমাট কয়েক মাস হাসপাতালে থেকে রোগ ব্যারাম চিকিৎসা সম্পর্কে তার জ্ঞান জন্মেছিল অথবা বাড়িতে দু-একটা ডাক্তারি বই আর পঞ্জিকার বিজ্ঞাপন পড়ে বিদ্যালাভ করে সে বোকা গরিব নিরুপায় মানুষদের চিকিৎসা করার পেশা নিয়েছিল কে জানে।
অন্যরকম দু-চারজন ডাক্তার কবরেজ হাকিম এদিক ওদিক আছে, তারা সকলেই নিজে নিজে চিকিৎসা শেখা বাজে লোক, কিন্তু চালাক চতুর শঙ্করের উপর গৌরীর এত বিশ্বাস কেন তাই বা কে বলতে পারে!
ক দাগ ওষুধ ঈশ্বরের পেটে গিয়েছিল কেউ বলতে পারবে না।
নদেরচাঁদের বৌ হয়তো বললেও বলতে পারত–গৌরী নগদ পয়সা দিয়ে ডাক্তার আনিয়েছে। ওষুধ আনিয়েছে এই খবর শুনে সে একটু বেশি রাত্রে ধার চেয়ে ভিক্ষা চেয়ে কয়েক আনা পয়সা আদায়ের চেষ্টা করতে গিয়েছিল। কথার ছলে দরদ দেখাতে গিয়ে সে কি আর জিজ্ঞাসা করে নি যে, ডাক্তার কি বলেছে, ঈশ্বর ক দাগ ওষুধ খেয়েছে এবং ইতিমধ্যেই ওষুধে কাজ হবার লক্ষণ দেখা গিয়েছে?
কিন্তু ঘরে আর ফিরতে পারল কই নদেরষ্টাদের বৌ!
পাগলা নদীর কাঁচা বাঁধভাঙা মানুষসমান উঁচু ঢল প্রচণ্ড গর্জনে ছুটে এসে খড়কুটোর মতোই তাকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল কেউ জানে না!
হয়তো বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে হলুদ নদীর আসল স্রোতে।
অথবা হয়তো সে গিয়ে উঠেছে সবুজ বনের কোথাও, বন্যা শেষ হবার আগেই সেখানে সে মিলেমিশে শেষ হয়ে যাবে।
নদেরচাঁদের বৌ নাকি ছুটতে ছুটতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়েছিল, মুখখামুখি দাঁড়িয়ে কয়েক মুহুর্তের মধ্যে কয়েকবার কপালে হাত ঠেকিয়ে ঢলকে প্রণাম করেছিল পাকা বাড়ির ছাতে দাঁড়িয়ে শম্ভু নিজে নাকি সে দৃশ্য দেখেছিল–গায়ের পাগলাটে স্বভাব-কবি ষাট পেরোনো শম্ভু।
কী তার বর্ণনা সেই দৃশ্যের!–বন্যার আদত ঝঞাট মিটে যাওয়ার পর জেরটা চলতে থাকার সময় পূজামণ্ডপে পূজার উৎসবে আনন্দ করতে সমাগত মানুষগুলির গায়ে কয়েকবার কাটা দিয়েছিল শুনতে শুনতে।
হয়তো নদেরচাঁদের বৌ কয়েক মুহূর্তের অবসরে যুক্ত কর কপালে ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে যতবার ঢলকে প্ৰণাম জানাতে পেরেছিল ঠিক ততবারই গায়ে কাঁটা দিয়েছিল সকলের।
মেঘলা আকাশ ছাড়া ছাড়া ভাঙা ভাঙা মেঘ। কয়েক মুহূর্ত আগে চতুর্দশীর চাদ একখণ্ড মেঘের আড়াল থেকে মুক্তি পেয়ে কঁকা আকাশের খণ্ডটায় এসেছিল। গর্জন করে এগিয়ে আসছে। বাঁধভাঙা জলের তোড়, সেই ফেনিল ভয়ঙ্কর গতিশীলতায় পড়েছে প্রাক্-পূর্ণিমার চাঁদের আলো–সুন্দরতম যেন উন্মাদ হয়ে ছুটে চলেছে। শম্ভুরও নাকি সাধ হয়েছিল প্রণাম করার।
এ-কাঁধে নাতি ও-কাঁধে নাতনিকে নিয়ে প্রাণপণ চেষ্টায় ভাঙা সিঁড়ি বিয়ে সে ছাতে পালিয়েছিল, দুহাত আটক ছিল ওই দুটো বাচ্চার ভয় কমাতে দুজনকে বুকে চেপে ধরে লেপ্টে রাখার জন্য।
কিন্তু জ্যোত্মায় উদ্ভাসিত মহাসুন্দরের রূপধরা সেই ফেনাময় সর্বনাশকে জগৎ-জীবন কাটিয়ে দেওয়া আওয়াজ তুলে এগিয়ে আসতে দেখে তারও সত্যি নাকি কামনা জেগেছিল, বাচ্চা দুটোকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে দুটি হাত মুক্ত করে নিয়ে অন্তত একবার প্রণাম জানাতে।
ঈশ্বরের মাটির ঘর। প্রথম তোড়েই হেলে পড়েছে। তিন পুরুষের আমকাঠের চৌকিতে শায়িত জ্বরে অজ্ঞান ঈশ্বরকে বুকে তুলে নিয়ে চৌকিতেই উঠে দাঁড়িয়ে সামলাতে হয়েছে বধভাঙা ঢাল-বন্যার প্রথম তোড়।
কুনো আর বাচ্চা মেয়েটাকে বুকে নিয়ে পিসিও দাঁড়িয়েছে চৌকিতে। ভাগ্যে খড়ড়া ঘরের মাটির ভিটেটা অনেক উঁচু করে গাঁথা হয়েছিল—কপুরুষ আগে কে জানে।
নইলে আজ রক্ষা থাকত।
খুঁটি জীর্ণ হয়ে গিয়েছে। হেলে-পড়া চালাটা ঢলে পড়বেই! উঁচু করে গাঁথা মাটির ভিত, তার উপরে তিন পুরুষ আগেকার শক্ত উঁচু চৌকি। সেই চৌকির ওপরে জ্বরে অজ্ঞান স্বামীকে বুকে জাপটে ধরে ঘন অন্ধকারে এক হাঁটু জলস্রোতে দাঁড়িয়ে গৌরী জিজ্ঞাসা করে, কি করা যায় বল তো পিসি?
পিসি বলে, কি আর করা যাবে? এখনকার মতত বাঁচবার চেষ্টা করি আয় তারপর দেখা। যাবে। জল চাদ্দিকে ছড়িয়ে গেলে ভোর তক্ ভিটের কাছে নেমে যাবে সন্দ করি। সেবারও এমনি হয়েছিল।
গৌরী বলে, ভোর তক্ তুই আমি এমনিভাবে সেঁড়িয়ে রইব? এর মধ্যেই মানুষটার ভারে হাত-কঁধ যে টনটন করছে পিসি!
পিসি অভয় দিয়ে বলে, না না, ভোর তক্ রইতে হবে কেন! মোর হাত-কাষ টনটন করছে। না? বাঁধ ভেঙে জল এসেছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে। হাঁটুর ওপরে ছিল, হাঁটুর নিচে নেমেছে দেখছি না? আস্তে আস্তে চৌকির তলে নেমে যাবে।
কুনো কেঁদে উঠলে পিসি ধমক দিয়ে বলে, কাঁদলে জলে ফেলে দেব–চুপ কর।
তারপর গৌরীকে বলে, জল নেমে গেলেও চৌকির উপরটা কাদায় ভর্তি হয়ে থাকবে। চৌকিটা না ধুয়ে কিছু একটা না পেতে মানুষটাকে তো শোয়াতে পারবি নে।
চালাটা কাত হয়ে উল্টে পড়ে যায়।
চতুর্দশীর চাঁদের আলো খানিকক্ষণ আলোকিত করে রাখে তাদের প্লাবিত ঘর। তারপর বর্ষণমুখর মেঘ এসে চাদ ঢেকে তাদের ভিজিয়ে দিতে থাকে।