গর্ভবতী উপপত্নীকে দূরে কোথাও সরিয়ে নিয়ে রেখে, যথাসময়ে তীর্থযাত্রার নাম করে ধৰ্মপত্নীকে নিয়ে কিছুকালের জন্য বিদেশে কাটিয়ে একেবারে ছেলে নিয়ে বাড়ি ফিরলেই ব্যাপার চুকে গেল।
ইরানী কোনো পুরুষ চাকর বাকর পাইক বরকন্দাজ যদি বহাল থাকত তবে সেই পূর্বপুরুষটির গায়ের রং নিয়ে প্রভাসের লজ্জা আর কেলেঙ্কারির অবধি থাকত কিনা সন্দেহ।
বিজ্ঞান কি বলে জানা না থাক, অনেক পুরুষের সঞ্চিত সাধারণ জ্ঞান দিয়েই গায়ের লোক ধরে ফেলত, এ বংশে কেন ইরানী সংস্করণের ছেলে জন্মায়।
সাদাসিধে কিন্তু ইট আর সিমেন্টে মোটা করে গড়া শক্ত পাকাপোক্ত একটা ক্লাব-বাড়ি গড়ার বুদ্ধি গজিয়েছিল বুড়ড়া উইলি জেনকিন্সের মগজে।
সে ছিল খাঁটি ইংরেজ।
মাঝবয়সী মোটাসোটা ফ্রেডারিক জনসনকে প্রধানের পদটা ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরে যাবার আগে তিনটি খাঁটি আর সাতটি মিশেল ইংরেজ পরিবারের নিরাপত্তার জন্য বড়ই ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল জেনকিন্স।
দেশে ফিরতেও সে ব্যাকুল হয়েছিল। তিরিশ বছর এদেশে কেটেছে। তবু এটা বিদেশ। দেশে ছাপানো বই ম্যাগাজিন পত্রপত্রিকা পড়ে, আত্মীয়বন্ধুর সঙ্গে নিয়মিত চিঠিপত্র লেখা বজায় রেখে, চার-পাঁচ বছর পরে পরে কয়েক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে ঘুরে আসে। প্রথমবার বৌ আর ছেলেমেয়ে দুটিকে সঙ্গে নিয়েছিল, তারপর থেকে একাই গিয়েছে এসেছে। বারে বাপ একলা যাওয়া আসার খরচটাই কি সোজা! এদিকে মাতৃত্বগর্বিনী পত্নী মিনার্ভার কল্যাণে ফেমিলি বেশ কেঁপে উঠেছে।
জেনকিনসের একা দেশে বেড়াতে যাওয়া নিয়ে তাদের দু-তিন সপ্তাহব্যাপী উগ্র করুণ বিরামহীন দাম্পত্য কলহ উতলার জানাচেনা মানুষ থেকে চাপরাসী দারোয়ান জমাদার মেথররা পর্যন্ত উপভোগ করত–সাময়িকভাবে ভাড়া করা শিক্ষিতা নার্স আড়ালে হাসাহাসি করত অশিক্ষিতা আয়ার সঙ্গে।
তার নিজের বাংলোয় শুধু বিলিতি আপনজনদের একটা টি-পার্টি ডাকিয়ে ছোট ঘরোয়া বৈঠকে সে তার প্ল্যানটা পেশ করেছিল। এইরকম বাংলো প্যাটার্নের বাড়িতে তাদের বসবাস। উত্তেজনার সময় নেটিভরা ক্ষেপে গিয়ে দল বেঁধে আক্রমণ করলে, সময়মতো সৈন্য পুলিশ হাজির না হলে, তাদের শুধু কয়েকটা বন্দুক ভরসা। কিন্তু উন্মত্ত জনতার জোয়ারের মতো আক্রমণ কি শুধু কয়েকটা শখের বন্দুক দিয়ে ঠেকানো যায়? এমন একটা আশ্রয়ও দরকার, দশ-বিশ হাজার মানুষ হুড়মুড় করে এসেও সহজে যে আশ্রয় ভাঙতে পারবে না, কটা বন্দুক নিয়েও তারা সৈন্য পুলিশ হাজির হওয়া পর্যন্ত আত্মরক্ষা করতে পারবে।
ক্লাবের জন্য বাড়ি তৈরি করার কথাবার্তা চলেছে সাধারণ বাড়ির বদলে ছোটাখাটো শক্ত। দুর্গের মতো ওইরকম একটা বাড়ি গড়া হোক।
তিনজন মিসেস একবাক্যে তাকে সমর্থন জানিয়েছিল, পৌঢ় বয়সে অতিরিক্ত বুড়িয়ে যাওয়া এবং একটু বাঁচালে পরিণত হওয়া ফিরিঙ্গি সমাজের ফস্টার বোস গাল চুলকাতে চুলকাতে বলেছিল, প্রস্তাব মন্দ কি!
কিন্তু অন্যেরা চুপ করে ছিল।
জেনকিন্সের এতদিনের প্রধানের আসনটা দখল করবে যে নবাগত জনসন, তার হাই তোলার ভঙ্গিটা জেনকিন্সের বড়ই বিশ্রী লেগেছিল।
তখন নিজেদের সেই ঘরোয়া বৈঠকে নাটক সৃষ্টি করেছিল তরুণ বয়সী রবার্টসন। সে পরিষ্কার স্পষ্ট ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছিল, মাপ করবেন, ইউ আর রং, ভেরি ভেরি রং।
মাথা ঘুরে গিয়েছিল জেনকিন্সের। বিশ বাইশ-বছরের একটা ছোকরা, বছর দেড়েক মোটে শিক্ষানবিসি করছে, বিদেশ থেকে এসে কি করে এদেশে কি করতে হয় সবে শিখতে শুরু করেছে–তার মুখে এমন স্পষ্ট বেয়াদবি ইউ আর রং ভেরি রং!
তবু জেনকিন্স তাকে ক্ষমা করেছিল। উদারভাবে তার দিকে তাকিয়ে স্মিতমুখে ইংরেজিতে বলেছিল, ইয়ং ম্যান, তুমি শুধু দেখবে শুনবে আর বুঝবার চেষ্টা করবে। আমাদের মতো বুড়ো ঘাগীদের কাছে শিখবে। নইলে জানবে বুঝবে চালাবে কি করে তোমরা?
কিন্তু দেখা গিয়েছিল অল্পবয়সী রবার্টসন একা নয়, আরো কয়েকজন তাকে সমর্থন করে না।
তার নিজের মেয়েও নয়!
ন্যান্সী পড়ত কলকাতার কলেজে। পরীক্ষায় ইংরেজি আর অঙ্কে বিশ্রীভাবে ফেল করবার খবর পেয়ে কদিন সে ভয়ানক মনমরা হয়ে ছিল।
হঠাৎ যেন তাজা হয়ে অতি বেশি উৎসাহের সঙ্গে রবার্টসনকে সমর্থন করে বলেছিল, ইউ আর রং পাপা, হি ইজ রাইট। এখন কি সেকাল আছে যে, একটা ইটের বাড়ির ফোর্ট হলেই সামলানো যাবে?
রবার্টসনের পায়া গিয়েছিল বেড়ে। সে জোর গলায় ঘোষণা করেছিল, আমি বলি কি, বাড়িটা খাঁটি ভারতীয় স্টাইলে তৈরি হোক। আমরা তো মোটে কজন–ক্লাব করে লাভ কী? কয়েকজন বাছা বাছা নেটিভ বাবুদেরও মেম্বার করা হোক। বিশেষ ব্যাপারে দরকার হলে আমরা তো এমনিভাবে আমাদেরই কারো বাড়িতে জড়ো হতে পারব। ক্লাবে খোলাখুলি মেলামেশা চলুক।
মতবিরোধের মীমাংসা করে দিয়েছিল কমিশনার সাদারল্যান্ড।
ক্লাব-বাড়ির দেয়াল হবে ইটের কিন্তু প্ল্যাস্টারিং ও রং করা হবে এমনভাবে যে, দেখলে মনে হবে ঠিক যেন মাটির দেয়াল। চালা তৈরি হবে শক্ত ধাতুর পাতা দিয়েই কিন্তু খড় বা শণ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে।
অর্থাৎ স্টাইলটা হবে খাঁটি দেশী কিন্তু বাড়িটা হবে যতদূর সম্ভব পোক্ত।
জেনকিন্স নাকি আজো বেঁচে আছে প্রায় নব্বই বছর বয়সে।
বছর পাঁচেক রবার্টসনের মেমসায়েবি করে, দুটি বাচ্চা বিইয়ে, আদালতী ডাইভোর্স-ব্যবস্থায় ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে ন্যান্সী কবে বিদায় নিয়েছিল সে নাকি এখন একজন বোম্বেওয়ালা লোহার কারবারির ঘর-সংসার করছে।