ধরাধরি করে রবার্টসনকে টেবিলটাতে শুইয়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু প্রভাসের হাতেও কি জোর ছিল! দেখা যায় রবার্টসনের মাথার আঘাত গুরুতর নয়, আধা ইঞ্চির মতো চামড়া শুধু কেটেছে, মাথার খুলি ফাটে নি।
রামসুখলাল তার মাথায় আইডিন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয়।
আইভি প্রায় হুকুমের সুরে তাকে একেবারে গাড়িতে তুলে দিতে বলে।
রামসুখলাল সরু চুরুটে শেষ টান দিয়ে গোড়াটা অ্যাশট্রেতে ফেলে দিতে দিতে বলে, ড্রাইভার আর্দালিকো বলিয়ে।
সাবকো তবিয়ৎ ঠিক হোনেকা বাদ তুমকো মার ডালেগা।
ঠিক হয় মেমসাব!
রবার্টসন বিদায় হয়ে যাবার পরও প্রভাসের পেগ টানা চলতে থাকে। চাকর খানসামা ছাড়া। ক্লাব একরকম তখন খালি হয়ে গিয়েছে। একটু ঝিমিয়ে প্রভাস দ্যাখে, গ্লাস খালি। রেগে আগুন হয়ে ওঠে।
রামসুখলালকে ডেকে গালাগালি দিতে দিতে আরেকটা পেগের অর্ডার দেয়।
পেগ আনতে বড় বেশি দেরি হয়, প্রভাস চেঁচামেচি শুরু করে, তারপর ক্লাবের উর্দিপরা বয় পেগ নিয়ে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শাড়ি গয়নায় জমকালো বনানী এসে প্রভাসের চেয়ারের পাশে দাঁড়ায়।
রামসুখলাল লোক পাঠিয়ে আগেই তাকে খবর দিয়েছিল।
বনানী হুকুমের সুরে বলে, আর ওসব গিল না, এবার বাড়ি চল।
প্রভাস মাথায় একটা ঝকি দেয়। মদের গ্লাসটা নামিয়ে রেখে বয় চলে গিয়েছে, ওই গ্লাসটাই জগতে তখন একমাত্র সত্য বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু বনানী পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
বাড়ি যাব?
যাবে না? রাত কম হয়েছে? গাড়িতে বসে গিলতে গিলতে চল।
বনানী গ্লাসটা এক হাতে তুলে নেয়, অন্য হাতে প্রভাসকে ধরে তাকে উঠে দাঁড়িয়ে টাল সামলে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।
রামসুখলাল নীরবে কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার জানায়। মাথা হেলিয়ে বনানীও নীরবেই। তার বিনয় স্বীকার করে।
০২. হলুদ কাদায় ঘোলা নোনা জলের নদী
হলুদ কাদায় ঘোলা নোনা জলের নদী। হাঙ্গর কুমির আর নানাজাতীয় মাছে ভরা। ডাঙায় বন বাঘ ভালুক হায়না শেয়াল থেকে নিরীহ হরিণ এবং নানাজাতীয় সরীসৃপ, জোক বিছা আর পোকামাকড়ে ভরা।
সংখ্যার হিসাবে স্বজনতান্ত্রিক মশারাই অতুলনীয়–হিংসার হিসাবেও বটে। নদীর হাঙ্গর কুমির আর বনের বাঘ ভালুক সাপেরা বছরে যত মানুষের প্রাণ নেয়, মশারা দলে দলে হুল ফুটিয়ে তার চেয়ে কতগুণ বেশি মানুষকে যে আখেরে ঘায়েল করে!
নদী আর বনের এই পরিবেশে এলোমেলোভাবে ছড়ানো গ্রামগুলি কারখানাকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠা ছোট শহরটিকে ঘিরে আছে।
নদীর এপারের পাশাপাশি কয়েকটা গ্রামে কারখানাগুলি গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি মানে ঠিক নদীর ধারঘেঁষা পাশাপাশি গ্রাম বললে ভুল হবে ডাঙার দিকের পাশঘেঁষা গ্ৰামও আছে বটে।
নদীর এপারে ওপারে আদিম অরণ্য। এপারে দক্ষিণে মাইলতিনেক তফাতে বনের প্রান্ত, ওপারে বন খানিকটা উত্তরে এগিয়ে গিয়েছে। কারখানাগুলি যেন মায়ামন্ত্রে শহুরে ভাব এনে দিয়েছে। তারই একটা অংশে।
হাটের বদলে বাজার বসে। এপারে ওপারে কয়েকটা মুদিখানা মনিহারি দোকান আছে। একতালা বাড়ি হলেও পাকা ক্লাব-বাড়িতে প্রতিদিন চারটে পেট্রোম্যাক্স জ্বলে যেন মিথ্যা ঘোষণা করে দেয় ঘন বনের গাঢ় অন্ধকার আর বনের গায়ে এলোমেলোভাবে ছড়ানো গ্রামগুলি ডিবরি এবং দু-একটা ধোঁয়াপড়া লণ্ঠনের মিটমিটে আলোয় এখানে ওখানে ঈষৎ স্তিমিত ঘন গাঢ় কালো অন্ধকারকে!
প্রধানত কারখানাগুলির প্রয়োজনেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। বাড়িতে সরবরাহ করা হয় না, বড় বড় রাস্তাগুলিতে বিদ্যুতের আলো জ্বলে। ভবিষ্যতে বাড়িতে বাড়িতেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করার একটা পরিকল্পনা আছে কিন্তু কেন সেটা কার্যে পরিণত হয় না সে এক রহস্যময় ব্যাপার।
কিছু সায়েব আর কিছু গণ্যমান্য ধনী ও উচ্চপদস্থ বাবু মিলে প্ল্যান করে ক্লাব-বাড়িটা তৈরি করিয়েছিল। ইংরেজি তিরিশ সালের পর দু-তিন বছরের মধ্যে হুড়মুড় করে নতুন কয়েকটা কারখানা যখন গড়ে উঠেছিল।
সায়েব মানে খাঁটি ভেজাল ছোট বড় আসল নকল সব রকম সায়েব। পরস্পরের কুঁচকুঁচে কালো রঙের পাল্লা দিয়েছিল কড়া হাকিম গুপ্ত সায়েব আর টিম্বার প্লেট কোম্পানির লোকনাথম। কয়েকজনের রং কালো না হলেও ছিল ময়লা। কয়েকজনের রং ভেজাল সায়েবদের তুলনায় তেমন কিছু মলিন ছিল না। প্রভাসের রং অতুলনীয়, খাঁটি সায়েবদের সাদা রঙের হিসেবে না হোক, দুধে আলতার নিরিখে ক্লাবের সব খাঁটি খাঁটি সায়েবদের হার মানিয়ে দিচ্ছে।
তিনপুরুষ আগে প্রভাসের বংশগত রক্তধারায় ইরানী রক্ত সঞ্চারিত হওয়ার একটা সম্ভাবনা অবশ্য ঘটেছিল। কিন্তু যোগসূত্রটা গাঁয়ের মানুষ ঠিকভাবে ধরতে পারে নি, হারিয়ে ফেলেছে।
সকলে জানত কোনো বংশের রক্তধারায় নতুন কিছু ঢোকাতে পারে শুধু পুরুষ, প্রভাসের ঠাকুরদার বাপের আমলে অন্দরে ঠাঁই পেয়েছিল দুটি ইরানী স্ত্রীলোক, প্রৌঢ়া মা আর তার তরুণী মেয়ে।
কোথা থেকে কিভাবে কেন তারা আধা-রাজা আধা-জমিদারটির অন্দরে এসেছিল, কয়েক বছর পরে কেনই বা আবার একদিন রাতারাতি উধাও হয়ে গিয়েছিল, সে সব পুরোনো জটিল ব্যাপার এ কাহিনীতে অপ্রাসঙ্গিক। আশ্চর্য এই যে, পুরোনো রূপকথা উপকথায় ছেলে ছেলে করে পাগল রাজাদের নানা বিচিত্ৰ উপায়ে পুত্রলাভের গল্প-জানা মানুষগুলির কল্পনাতেও আসে না যে, ইরানী উপপত্নীর গর্ভজাত সন্তানকে নিজের ধৰ্মপত্নীর সন্তান বলে চালিয়ে দেওয়া মোটেই কঠিন বা অসম্ভব ছিল না।