বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগের দায় নেবার আগে রামসুখলাল স্পষ্ট পরিষ্কার ভাষায় জিজ্ঞাসা করেছিল যে, দরকার হলে তাদের কোনো একজনের উপর বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করলে তাকে শেষ পর্যন্ত হাজতে যেতে হবে না তো?
রবার্টসন তাকে অভয় দিয়ে বলেছিল, নিশ্চয় না! ইউ উইল বি লাইক এ ফাদার টু আস। তবে কিনা, আমাদের আনন্দ উৎসবে কখনো ব্যাঘাত ঘটাবে না।
প্রভাস তাকে আরো স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে বলেছিল, এমনিতে তুমি কিছুই করবে না, খুব খারাপ রকম গোলমাল ঘটবে টের পেলে তখন সামাল দেবে। সব সময় বুদ্ধি খাঁটিয়ে কৌশলে কাজ হাসিলের চেষ্টা করবে।
রামসুখলাল পাকা লোক, আসল কথাটা খোলসা করে নিয়েছিল। জিজ্ঞাসা করেছিল, সে ঠিক কাজ করছে না তার গলতি হয়েছে বিচার হবে কিভাবে, কে বিচার করবে?
তাকে জানানো হয়েছিল যে, তারা পাঁচজনে মিলে সাদা মাথায় বিচার করবে, তার কোনো ভয় নেই।
মিলেমিশে পরামর্শ করে দুজনে একসাথে বাঘ শিকার করতে গিয়েছিল, এখন তফাতে সরে পরস্পরের দিকে প্রায় পিছন ফিরে বসে কৌতূহলী শ্রোতা কয়েকজনকে তারা শিকারের গল্প। শোনায়।
শ্রোতার সংখ্যা খুব বেশি নয়। মাঝহার রাত, পরদিন আপিস কাছারি কলকারখানা সব খোলা। রাত এগারটার আগেই প্রায় তিন ভাগ সভ্য এবং অধিকাংশ সভ্যা বাড়ি ফিরে গিয়েছে।
বুড়ো কিংসলির মেয়ে আইভি, মিসেস জনসন এবং তার বিশেষ অনুগতা মিসেস বাগচী ছাড়া আর একজন সভ্যও আজ ক্লাবে উপস্থিত নেই।
দু-একজন একবার এ-টেবিলে একবার ও-টেবিলে গিয়ে বসে বটে কিন্তু মনে হয় মাঝরাত্রে আজ দুই দলে ভাগ হয়ে গিয়েছে ক্লাবের রাত্রিচর সভ্যেরা।
সভ্যা তিনজন রবার্টসনের টেবিলে যোগ দেওয়ায় তার দলটাই যেন ভারি হয়েছে।
এভাবে জের টানা চললে কোনো কথাই ছিল না।
কিন্তু আরো দু-এক পেগ গিলবার পর দুজনের গলাই চড়তে থাকে। সভ্য এবং সভ্যা তিনজনের এ-টেবিলে ও-টেবিলে ভাগাভাগি হয়ে যাবার কোনো মানেই থাকে না। সারা ক্লাবে দুজনের গলা আর টেবিল চাপড়ানোর আওয়াজ শোনা যায়। বাইরে দাঁড়ানো বন্দুকধারী দারোয়ান পাহারাদার, রামসুখলালের দেশভাই নামও শুনতে পায়।
পরস্পর যে শুনতে পাবে তাতে আর সন্দেহ কি। এ-টেবিলে ও-টেবিলের ফারাক মোটে কয়েক হাত।
প্রভাস দু-তিনবার শুনিয়েছে সেই এক কথাই আবার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকে, ভয়? ওরে বাবারে, ভয় পাব না! ভয় পেলে চলবে না জানতাম তাক করে গুলি চালালাম। আমার গুলি যদি না লাগত, এক গুলিতে যদি ঘায়েল না হত, আমরা কেউ প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারতাম? আমার গুলি ইটাল জায়গায় লেগেছিল বলেই মাচার দিকে না লাফিয়ে গোয়ালের চালার দিকে লাফ মারল—
রবার্টসনের গলাটা থেমেছিল। আচমকা উঠে গিয়ে সে ভাসকে একটা ঘুসি কমিয়ে দেয়।
প্রভাস সোডার বোতলটা লক্ষ্যস্থির রেখে ঠিকভাবে কষাতে পারলে হয়তো সেই রাত্রেই খতম হয়ে যেত রবার্টসনের জীবন।
বোতলের আঘাতটা তার মাথার বা পাশে পিছলে গিয়ে বা কাঁধে লাগে।
হাতটা আড়ষ্ট হয়ে যায়।
তাই, হাতাহাতি ঘুরাঘুসি শুরু হতে রবার্টসন বেকায়দায় পড়ে যায়। তার কয়েকটা ঘুসিতেই প্রভাস ক্লাবের সিমেন্ট করা মসৃণ মেঝেতে কাত হয়ে পড়ত রবার্টসনের বা হাতটা অবশ হয়ে যাওয়ায় দুজনের ঘুসোঘুসি শহরের রাস্তার সস্তা মারামারি হয়ে দাঁড়ায়।
আইভি পাগলিনীর মতো চেঁচায়, রামসুখলাল! রামসুখলাল! সামাল দাও।
আইভি এলবার্টের বিধবা স্ত্রী। উৎসাহী হাসিখুশি জোয়ান বয়সী এলবার্টের শোচনীয় মৃত্যুটা প্রায় এক বছর পরে আজো আলোচনা ও আফসোস প্রকাশের বিষয় হয়ে আছে।
দিনের বেলা বনে শিকার করতে গিয়েছিল। ঝোপ থেকে বেরিয়ে তেড়ে এসেছিল ধেড়ে একটা বিষাক্ত সাপ।
বিপদে মানুষের কি রকম মতিভ্ৰম ঘটে। সঙ্গে ছিল দুটো বন্দুক একটাতে পোরা ছিল বুলেট, আরেকটার দুটো নলে ছররা।
সঙ্গের লোকের হাত থেকে চট করে দামি মারাত্মক রাইফেলটা ছিনিয়ে নিয়ে এলবাৰ্ট সাপটাকে গুলি করেছিল কিন্তু ছোবল মারতে তেড়ে আসা বিষাক্ত উগ্র মেজাজী জাতসাপকে কি বুলেট দিয়ে ঠেকানো যায়?
শুধু ঈশ্বর নয়, সকলেরই অভিমত যে, দোনলা বন্দুকটা নিয়ে ছররা মারলে এলবাৰ্টকে সেদিন মরতে হত না।
বিদ্যুৎগতিতে এসে উরুতে ছোবল দিয়ে বিষ ঢেলে দিয়েছিল।
কি তেজী বিষ! বাঁধন ছাদনের ব্যবস্থা করে ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে ডাক্তারের কাছে হাজির করিয়েও তাকে বাঁচানো যায় নি। রক্ত জমে এসে তখন তার নাড়ি প্রায় ছেড়ে গিয়েছিল।
সম্প্ৰতি কিছুদিন যাবৎ আইভি ও রবার্টসনের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে নানারকম কানাঘুষা চলছিল।
দুজনের হাতাহাতি মারামারি চলছে। অন্য সভ্যেরা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা উপভোগ করছে। খালি হাতে ফাইট চালালে সে ব্যাপারে অন্য কারো হস্তক্ষেপ করা ক্লাবের রীতি নয়। হাতাহাতি মারামারি করার অধিকার প্রত্যেক সভ্যের সংরক্ষিত।
মারামারি করতে অস্বীকার করার অধিকার সংরক্ষিত একজন মারামারি করতে অস্বীকার করলে তখন অপর জনকে বিরত থাকতে হবে।
রামসুখলাল ধীরেসুস্থে একটা সরু চুরুট ধরায়।
বলে, আপনাসে সব ঠিক হো যায়েগা। ডরাতা কাহে?–বন্দুক আগে লে লিয়া।
সোডার বোলটা মেঝেতে পড়ে গিয়েও ভাঙে নি। এক ফাঁকে হঠাৎ সেটা কুড়িয়ে নিয়ে প্রভাস রবার্টসনের মাথায় মেরে বসে।
আঘাতটা এবার ঠিক জায়গাতেই লাগে। রবার্টসন কাত হয়ে মেঝেতে পড়ে যায়।
আইভি খ্যানখেনে গলায় প্রভাসকে বলে, তোমার লজ্জিত হওয়া উচিত। ধিক্ ধিক্–ইউজিং এ সোডাওয়াটার বোটল লাইক এ চিপ ভাল্লুর রাফিয়ান!