একটা জোরালো হাসির কলরব ওঠে অনেকগুলি গলায়। ইতিমধ্যে লোক এসে জমতে শুরু করেছিল। কঁকা জায়গায় পেট্রোম্যাক্সের বাতি জ্বালিয়ে যেন পালাগানের আসর বসেছে, রসিক অভিনেতা ঈশ্বর যেন সকলকে হাসাবার জন্য ভারি মজার একটা লাগসই মশকরা করেছে, এমনিভাবে সকলের গলায় হাসির আওয়াজ ওঠে।
বড়ই চটে যায় প্রভাস আর রবার্টসন।
রবার্টসন গর্জন করে বলে, এই শালা শুরকা বাচ্চা, কাহে তুম মেরা শের কো লাথি মারা?
সকলে সচকিত হয়ে চুপ করে যায়। যাত্রাগানের আসরে এর অনেক কম দামি এই রকম আলো একটাই হয়তো জ্বলে, তিনটে দামি বাতির আলোয় আবছা আঁধার খানিক দূর পর্যন্ত হটে গিয়েছে, কিন্তু এতগুলো মানুষের হঠাৎ চুপ করে যাওয়ায় এতক্ষণে যেন চারিদিক থেকে মাঝরাত্রির স্তব্ধতা ঘনিয়ে আসে।
প্রভাসও তাকে গলা ফাটিয়ে ধমক লাগায়, তোর তো আস্পর্ধা বড় বেশিরকম বেড়ে গিয়েছে। ঈশ্বর! আমার মারা বাঘকে তুই লাথি মারিস!
ঈশ্বর একটু বিভ্রান্তভাবে দুজনের মুখের দিকে তাকায়।
রবার্টসন একটা সিগারেট অফার করে, শিশিটাও বাড়িয়ে দেয়। প্রভাস সিগারেটটা ধরায়, শিশিটা নেয় না, ইংরেজিতে জানায় যে, নীট মদ খেলে তার সহ্য হয় না।
ইঙ্গিত পাওয়ামাত্র মেঘনাদ সোডা মেশানো মদের পাত্ৰ এনে এগিয়ে দেয়। প্রভাস এক নিশ্বাসে পান করে।
তাদের দুজনের ধমক খেয়েও ঈশ্বর মরা বাঘটার গা ঘেঁষে দুৰ্বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে রাগটা এবার মাথায় চড়ে যায় প্রভাসের। সে গর্জন করে হুকুম দেয়, পিটিয়ে ওকে লাশ করে দে তো সবাই মিলে।
মোট এগার জন বয় খানসামা আর্দালি চাকর আজ রাতের জন্য বিশেষভাবে ভাড়া করা তিনজনকে ধরে। তবু প্রভাসের হুকুম তারা শুনেও যেন শুনতে পায় না।
তিনটে তেজী বাতির আলোতে শুধু চোখেই পড়ছে না যে, খানিক তফাতে প্রায় দেড় শ মানুষ জড়ো হয়েছে; প্রভাস ও রবার্টসন গর্জন করে ঈশ্বরকে ধমক দেবার পর কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধ হয়ে থেকে আবার সকলে তারা মুখ খুলেছে। চাপা উত্তেজনায় নিচু গলার কথা মিলিত গুঞ্জরণ হয়ে কানেও এসে পৌঁছাচ্ছে।
একজন চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করে, বংশীর বলদ দুটোকে মেরেছিল না রে ঈশ্বর?
ঈশ্বরের বদলে তাদেরই একজন চেঁচিয়ে জবাব দেয়, শুধু বংশীর বলদ দুটোকে? শালী কত গাই বলদ ঘায়েল করেছে হিসাব আছে রে ভাই!
আরেকজন চেঁচিয়ে বলে, মানুষ পেটে পোরে নি কে বলতে পারে? ছসাত দিন হয়ে গিয়েছে, ভোলানাথের ভাইটা আজো ঘরে ফেরে নি, ভুলে গিয়েছ সবাই?
ধীরে ধীরে ঈশ্বর ওদের দিকে সরে গিয়ে দাঁড়ায়।
রবার্টসন আবার শিশিটা গলায় কাত করে, ছাকা মদের ঝাঝেই বোধ হয় দু-এক মিনিটের জন্য তার দেহ মনে বিপরীত প্রক্রিয়া হয়।
সে শান্তভাবেই প্রভাসকে বলে, বাঘটাকে নিয়ে ক্লাবেই ফিরে যাই চল?
তাই যাওয়া যাক। ক্লাবে ফ্ল্যাশ লাইটে বাঘিনীর ফটো ভোলা হবে। দু-একটা বিখ্যাত কাগজে সেটা নিশ্চয় ছাপা হবে। ফটো তোলার জন্য ঈশ্বরকেও দরকার।
দেশী একজন শিকারিকে নিয়ে তারা পৃথিবীর সেরা বাঘ শিকার করতে গিয়েছিল। দেশী শিকারির ছবিও তোলা হবে। তবে সে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকবে বিনীতভাবে।
এত সম্মানের লোভ কাটিয়ে ঈশ্বর কখন যে নিঃশব্দে কেটে পড়েছিল কেউ টেরও পায় নি।
পা বেঁধে বাঁশে ঝুলিয়ে বাঘটাকে ক্লাবে নিয়ে যাওয়া হল। ফটোগ্রাফার ইসমাইলের পরামর্শ অনুসারে ক্লাব বাড়ির কাছাকাছি আমবাগানের সামনে ফটো তোলার ব্যবস্থা হল। সামনে রইল বাঘটা, বিশেষ ভঙ্গিতে বন্দুক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল প্রভাস আর রবার্টসন–পিছনের আমবাগান নাকি রাত্রির আবছা আঁধারে ফটো তোলার কায়দায় নিবিড় অরণ্যের রূপ নেবে।
ফটো তোলা হবার পর ইসমাইলের এক প্রশ্নে উৎকট হয়ে উঠল সমস্যাটা তাদের মধ্যে বাঘ মেরেছে কে?
দিল্লি বোম্বাই কলকাতায় বহুল প্রচারিত কাগজে ছাপা হবে, কিন্তু তাদের ফটোর নিচে তো লিখে দিতে হবে এত বড় রয়েল বেঙ্গল টাইগারটি কার গুলিতে নিহত হয়েছে।
দুজনের বসা শুরু হতেই ইসমাইল জানায় যে, কার গুলিতে বাঘ মরেছে সঠিকভাবে না জানলে ফটোটা কোনো কাগজে ছাপতে পাঠানোর দায়িত্ব সে নিতে পারবে না।
ক্লাবের বেতনভোগী সেক্রেটারি রামসুখলাল কয়েকজন সভ্যের সাহায্যে তাদের বচসা থামিয়ে। দেয়। বাঘের মাথায় বেঁধা বুলেট পরীক্ষা করে জানা যাবে কার বন্দুক থেকে সেটা বেরিয়েছেএ যুক্তি মেনে নিয়ে তারা বচসা বন্ধ করে কিন্তু রাগে দুজনে গরগর করতে থাকে। তারা ভিতরে গিয়ে বসার পর রামসুখলাল সর্বাগ্রে তাদের বন্দুক দুটি সরিয়ে ফেলে।
তার জানাই ছিল যে, রাগ তাদের কমবে না, পেটে আরো যত পেগ পড়বে মাথা শুধু তত বেশি বেঠিক হবে।
দুজনের মধ্যে হাতাহাতি মারামারি হোক, বিশ্রী একটা ব্যাপার নিয়ে ক্লাবে কয়েকদিনের জন্য সীমাহীন অশান্তির সৃষ্টি হোক সেটা সামলানো যাবে। কেঁকের মাথায় একজন আরেকজনকে গুলি করে মেরে ফেললে ব্যাপার দাঁড়াবে অন্যরকম সাংঘাতিক ব্যাপার।
মাথা ঠিক রেখে এসব হিসাব কষতে পারে বলেই অবশ্য রামসুখলালকে এত টাকা মাইনে দিয়ে ক্লাবের সেক্রেটারি করা হয়েছে, কোনো সভ্যকে বিশেষ অবস্থায় পেগ দিতে অস্বীকার করার মতো কয়েকটা বিশেষ ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে।
ক্লাব পরিচালনার কর্তাব্যক্তি পাঁচজন। নির্বাচিত নয়, স্বীকৃত। প্রভাস এবং রবার্টসন হল এই পাঁচজনের মধ্যে দুজন–ক্লাবের প্রথম থেকে।