চাষ আবাদ করে বা কারখানায় খেটে কিছু রোজগারের ধার ধরতে চাওয়ার পালা সে যেন বাতিল করে দিয়েছে চিরজন্মের মতো।
তার ঝোঁক চেপেছে বন আর বুনো নদীতে শিকার করে নিজের আর গৌরীর এবং অবশ্যই মা ও কালা পিসি আর তার তিন ছেলে এক মেয়ের জীবিকা অর্জন করার।
জমি কিছু আছে থাক। ঠাকুরদার মতো শিকারটাই সে আসল পেশা করতে চায়।
বন্দুক কেড়ে নিয়ে গিয়েছে!
যে বাঘটা দিনদুপুরে সুজন ঘোষের সেজ ছেলেটাকে নদীর ওধার থেকে বনে টেনে নিয়ে গেল, সে বাঘটা মারার জন্যেও তাকে কি একটা বন্দুক দেওয়া হবেনা?
দুই ধারে উঁচু পাড়। মাঝে চওড়া উথল নদী। কাদার পকে হলুদ বরণ। হাঙ্গর কুমিরের মোটেই অভাব নেই।
এই নদী সঁতরে পার হবার জন্যে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি রাখা।
বুদ্ধিমানের মতোই মাখন জোয়ার আসার পর সঁতরে নদী পেরোতে নেমেছিল।
ভাটার নদীতে নামলে তাকে হয়তো আর ওপারে গিয়ে পৌঁছতে হত না।
জোয়ার আসার সময় হাঙ্গর কুমিরেরাও খানিকটা বিব্রত বোধ করে। সমুদ্র বেশি দূরে নয়, এ নদীতে এখানে জোয়ার আসে রীতিমতো সমারোহের সঙ্গে।
সবচেয়ে বেশি সমারোহ হয় পূৰ্ণিমা-অমাবস্যার দিনে। সে এক দেখার ব্যাপার। বিশেষত পূর্ণিমার রাতে জ্যোৎস্নার আলোতে ভাটার শান্ত নদীর বুকে ছোট ছোট ঢেউগুলি ওঠানামা করে, সেই ঢেউ-নাচা সমতল বুকে সমুদ্রের দিক থেকে প্রচণ্ড গর্জন করতে করতে ছুটে আসে উচু ফেনিল জলের বাঁধনহীন তোড়।
দূরে থাকতেই আওয়াজও শোনা যায়, চাঁদের আলোয় ঘোলাটে জলের সাদা ফেনায় ঢাকা ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপটাও চোখে পড়ে।
যত এগিয়ে আসে, গর্জন তত বাড়ে, এপার থেকে ওপার পর্যন্ত বিস্তৃত গতির রূপধর জীবন্ত সৌন্দৰ্যও স্পষ্টতর হয়।
সামনে দিয়ে যখন চলে যায় তখন ডাঙায় নিরাপদ আশ্রয়ে দাঁড়ানো মুগ্ধ অভিভূত দর্শকের বুক ভয়ে কাপে।
এর নাম কোটালের জোয়ার।
চলতি একটা ছড়া আছে–
কোটালের জোয়ার এল গাঙে,
দেখো ভাই বাঁধ যেন না ভাঙে।
০৭. ঈশ্বর এলোমেলো
ঈশ্বর এলোমেলো টুকিটাকি কাজ করে, যেদিন যখন যেখানে সে কাজ পায়। কোনোরকম বাছবিচার নেই।
মাটি কেটে গাছ কেটে বয়ে নিয়ে যাওয়ার কুলিগিরি পাওয়া গেলে তাই সই।
গৌরীও বেঁচেছে।
সে একটা জ্যান্ত ছেলেও পেয়েছে।
ছেলেটা ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাঁদে। ঘুমের ঘোরেই গৌরী পাশ ফিরে তার মুখে মাই গুঁজে দেয়।
কাতরায় না!
ঈশ্বর পাগলের মতো গতর খেটে রোজগারের চেষ্টায় ঘুরে বেড়ায়।
আগের মতো তামাকপাতা কিনতে পারে না গৌরী আর বাচ্চাটার জন্যে।
বরং মরিয়া হয়ে ঠাকুরদার বাপের আমলের ওই বর্শা কুড়োল তীর ধনুক নিয়ে বাঘ শিকারে বার হয়ে মরে যাওয়া ভালো।
বন্ধুরা চাঁদা তুলে বাঁশ খড় কিনে এনে নিজেরা হাত লাগিয়ে খেটে, পোড়ানো ঘর নতুন করে ছেয়ে দিয়েছে।
চুরি হয়ে আগুনে পুড়ে সবই প্রায় গিয়েছে ঈশ্বরের। দল বেঁধে এসে চারিদিক থেকে আগুন লাগিয়েছিল, পেট্রোল ছড়িয়ে দিয়ে।
বাইরে থেকে ছোট দরজাটার শিকল তুলে দিয়ে তাদেরও পুড়িয়ে ছাই করে নি কেন–সে কথা ভেবে আজো ঈশ্বর কূল-কিনারা পায় না।
গোয়ালের চালার আশ্রয় থেকে নতুন ঘরে উঠে যেতে কোনো হাঙ্গামাই করতে হয় নি। কি তার আছে যে বয়ে নিয়ে যেতে হাঙ্গামা পোয়াতে হবে?
নতুন ছাওয়া ঘরে এসে কত তরঙ্গই যে ওঠে ঈশ্বরের প্রাণে। নদীর তরঙ্গ হার মেনে যায়।
গৌরী ক্ষীণস্বরে জিজ্ঞাসা করেছিল, পুরুমশায়রে ডাকবা না? শান্তি সস্ত্যন করবা না?
না।
পিসি বলেছিল, সাধে কি তোর এই দশা।
বিকালে আর নড়াচড়া করে না, ভোরে দুর্গানাম জপ করে, নানা দেবদেবীকে প্রণাম জানিয়ে, নতুন ঘরে এসেছে।
বাইরে কো টানার অভ্যাস সে ত্যাগ করেছে। ঘরে মাঝে মাঝে টানার অভ্যাসও একরকম ত্যাগ করতে হয়েছে। নইলে উপায় কি!
কষ্ট বিশেষ হয় না। যেভাবে হোক দুটো পয়সা রোজগারের চেষ্টায় মরিয়া হয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করার সময় যেন সাধও জাগে না ইকো টানবার, খেয়ালও হয় না, হুঁকো টানা জীবন থেকে একরকম বাদ গিয়েছে।
গৌরী বলে, বার বার বললাম, পান্তা খেয়ে গেলে না। পান্তা আছে, কচুর শাকও আছে।
রেগে টং হয়ে গিয়েও ঈশ্বর শুধু ধপাস করে বিচালির গদির বিছানার কোণে বসে পড়ে।
ঘরের চাল যারা ছেয়ে দিয়ে গিয়েছে, তারাই পেতে দিয়ে গিয়েছে হাসপাতাল-ফেরত গৌরী আর তার ও তার বাচ্চার জন্য খড়ের এই হাতখানেক উঁচু খাট অর্থাৎ বাঁশের মাচা। খাট নয় কেন?
বর্ষার ভিজে চপচপ ভিটে সাওতা দিতে পারবে না, দামি গদির চেয়ে কম নরম নয় নতুন। খড়ের মোটা উঁচু সাজানো স্তর উপরে তোেশক চাদর বিছানো না থাকলেও নতুন চটের বস্তা কেটে দু পুরল করে পেতে দেওয়া হয়েছে।
ও পান্তা খাওয়া যাবে না। পান্তা খেয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুম দিলে চলবে?
গৌরী বাচ্চার মুখ থেকে মাই ছাড়িয়ে পাশ ফেরে। বাচ্চাটা কাঁদেও না, নড়েও না।
আশ্চর্যরকম শান্ত। নেহাত খিদে না পেলে কাঁদে না, অঘোরে ঘুমিয়ে থাকে, নয়তো নিজের মনে হাত-পা নেড়ে খেলা করে।
গৌরী বলে, অকালে পেটে এসে মেরেই ফেলত কিনা তাই দয়া করে একটু রেহাই দিচ্ছে। বেশি যন্ত্ৰণা করলে উল্টে এবার যদি মেরেই ফেলি পা ধরে তুলে মাটিতে আছাড় মেরে!
হঠাৎ একটা কাজ জুটে যায়।
বন্ধুরাই তলে তলে চেষ্টা করে জুটিয়ে দেয়।
বিড়ি তামাক তো নেই-ই, ঘরে চালও বাড়ন্ত। সূর্য উঠবার আগেই নিজে উঠে ঈশ্বর ভাবছিল কিভাবে সে-বেলা পেট চালাবার ব্যবস্থা করা যায়।