জগৎ সংসারে কেউ নেই লখার মার। কত পুরুষ ওত পেতে আছে তাকে খাইয়ে পরিয়ে সুখে আরামে রাখার জন্যে। এইভাবে পেট চলে বলেই কি লখার মা ওদের কাউকে আমল দেয় না? অথবা ওদের আমল দেবে না বলেই সে এভাবে নিজের পেট চালায়?
ম্যালেরিয়ায় ভুগে ভুগে অল্প বয়সে লক্ষ্মণের মা যেন সাত বুড়ির এক বুড়ি হয়ে গিয়েছে। তার মাকেও তার চেয়ে কম বুড়ি মনে হয়।
মেয়ের দিকে আড়চোখে চেয়ে লক্ষণের মায়ের মা বলে, রাবণ রাজার রোগ। এত বছর ওই রোগে ভুগেও এ হারামজাদী মরছে না কেন বাছা? হাড় মাস কালি করে দিলে!
লক্ষ্মী বলে, ছিঃ, মরার কথা বলতে নেই!
সত্যিকারের বুড়ি তিরাশি বছরের রাধার মা সঙ্গে সঙ্গে বলে, না না, মরার কথা মা বললে কি দোষ হয় রে বাছা? মুয়ে শতবার শাপ দিক, মর তুই, মর তুই মনে মনে ঠিক বলছে, তোর মরণের বালাই নিয়ে মরি, তুই বেঁচে থাক শতেক বছর।
বাইরে দাওয়ায় বসে ঈশ্বর সব শুনছিল।
কয়েক বছর আগে হলে তার মনটা ঘরের ভিতরের মেয়েদের মতই গম্ভীরভাবে নাড়া খেত, প্ৰাণে রহস্যঘন ভাবের তরঙ্গ উঠত।
কিন্তু কবছর রবার্টসনের কারখানায় খেটে, হরেকরকম মানুষের সঙ্গে মিশে, তল্পিদার দেশী শিকারি হিসেবে প্রভাস রবার্টসনদের শিকার-সমারোহে কয়েকবার যোগ দিয়ে, গতবারের বাঘ মারার ব্যাপারটা থেকে অদ্ভুতরকম অভিজ্ঞতা লাভ করে, মনটা যেন কি রকম হয়ে গিয়েছে ঈশ্বরের।
আজ তার হাসি পায়।
মা অভিশাপ দিলেও সেটা হবে সন্তানের আশীর্বাদ!
জগৎ সংসারে প্রাণীদের জন্ম অবশ্য দিচ্ছে মায়েরাই। জন্মে যাতে বাঁচতে পারে তার গোড়ার ব্যবস্থাগুলিও করছে মায়েরাই।
মা ছাড়া জীব বা জীবন সম্ভব নয়।
কিন্তু আরেকটা দিকও তো আছে। ফ্ৰণ-হত্যা হচ্ছে না সংসারে? সন্তানকে মরণের মুখে তুলে দিয়েও ফুর্তি খুঁজে বেড়াচ্ছে না অনেক মা? অন্ধ মায়ার বিকারে অনেকে সন্তানকে মেরে ফেলছে না?
ঈশ্বরের মাথা গুলিয়ে যায়।
আজকাল একটু ভাবতে শুরু করেছে বলেই কি এসব ভাবনা তার মগজে সহ্য হয়।
যাক গে।
ভেবে লাভ নেই।
লাইসেন্স বাতিল করে দিয়ে ঈশ্বরের সেকেলে পুরোনো দেশী বন্দুকটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সুখের হামলা শুরু হবার কয়েকদিন আগে।
বন্দুক নেই। কিন্তু বন যে ওদিকে কেবলই তাকে ডাকে।
নাগালের মধ্য দিয়ে উড়ে যায় বা গাছের ডালে বসে থাকে নানা জাতীয় সুস্বাদু পাখি বাঁশবন ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে সামনে দিয়ে ছুটে পালায় আধা বন্য খরগোশ ও অন্যান্য ছোট জাতের জীব। ঈশ্বরের হাত নিশপিশ করে। এসব শিকার করতে তার দামি টোটারও দরকার হত না, নিজের তৈরি বারুদ গেদে পেরেক আর শিক কেটে ছররা বানিয়ে কাজ সারত।
বড় পেরেক গেদে ওই বন্দুক দিয়ে তিনবার সে নদী থেকে প্রকাণ্ড তিনটে শঙ্কর মাছ তুলেছে।
একবার একটা অচেনা অজানা প্রাণীও। বড় শিকার ঘায়েল করতে বেশি বারুদ গাদতে হয়, অনেকে তাকে সাবধান করে দিয়েছিল।
বন্দুকের নাল ফেটে গিয়ে বিপদ ঘটার আশঙ্কা তার মনেও যে জাগত না তা নয়, কিন্তু ভয়কে সে আমল দিত না।
বন্দুকটা খারাপ হয়ে যেতে পারে টের পাবার পর সে ও-ভাবে বড় কিছু শিকার করবার চেষ্টা বন্ধ করেছিল।
অল্প বারুদে পেরেকের ছয়ূরা দিয়ে পাখিটাখি মারলে বন্দুকের ক্ষতির আশঙ্কা ছিল না।
বন তাকে ডাকে।
বর্ষায় পুষ্ট ঘন নিবিড় সবুজের হাতছানি নয়। বাঘের গর্জন মাঝে মাঝে স্পষ্টই শোনা যায়। কল্পনায় শোনা যায়, দেখা যায় ছুটন্ত হরিণের খুরের শব্দ আর গায়ে বাড়ন্ত আগাছার ডাল পাতা ঘষা লাগার চিকন মধুর সিরসির আওয়াজ। চিতা নেকড়েদের অদ্ভুত চলাফেরা। গাছের গুড়ি জড়ানো অজগরের মাথা তুলে দুলে দুলে গা শিউরানো হিসহিস আওয়াজ।
বনে গাদাগাদি করা আরো কত রকমের হিংস্র ও নিরীহ প্রাণীর ডাক।
ভাটার নদীর ধারে হলুদ পাঁকে মরা কাঠের মতো রোদ পোহায় কুমির।
অনেকবার চেষ্টা করেও আজ পর্যন্ত বন্দুকটা দিয়ে একটা কুমিরও ঈশ্বর ঘায়েল করতে পারে নি।
রাইফেলের গুলি ছাড়া কুমিরের চামড়া ভেদ করে তাকে মারাত্মক রকম আহত করা যায় না।
কিন্তু বন্দুকটা থাকলে এটাকে যে মারতে পারত না তার কি মানে আছে?
একবার একটা অজানা অচেনা প্রাণীও।
এমন কিম্ভূতকিমাকার ছিল চেহারাটা যে, কেউ বলতে পারে নি সেটা মাছ, হাঙ্গর বা শুশুক জাতীয় জীব।
গৌরী বেরিয়ে এসে করুণভাবে বলে, হাঁ গো, দু-চারটে পয়সা হবে? ঘরে এসেছে–একটু পান সুপারি তে দিতে হয়।
একটা বিড়ি নেই, এক ছিলুম তামাক নেই। ঘরে চালও হয়তো বাড়ন্ত। ট্যাকে পাঁচটা পয়সা ছিল, কোনো কথা না ভেবে চোখ-কান বুজে তামাক কিনে আনার কথা ভাবছিল।
নীরবে সে পয়সা পাঁচটা গৌরীর হাতে তুলে দেয়।
আট-ন বছরের লক্ষণ একমুহূর্ত দিদিমার সঙ্গ ছেড়ে থাকতে পারে না। আজো সে এসে দিদিমার গা ঘেঁষে বসেছিল গৌরী তাকে পয়সা দিয়ে পান সুপারি আনতে পাঠায়।
ঘরের কাছেই নর ছোট্ট দোকান। বাজারে পয়সায় পান ছটা হলে নন্দ দেয় চারটে, কিন্তু এখন ওর দোকান থেকেই না আনিয়ে উপায় কি!
নন্দর দোকান থেকেই এক পয়সার বিড়ি আর চার পয়সার তামাক আনার কথা ঈশ্বর ভাবছিল!
গা জ্বালা করে। মেয়েরা সকলে চলে যাবার পরে গৌরীকে সে বিশ্রী একটা গাল দিয়ে বলে, তোর জন্যে কাজ গেল, উপরি গেল, বন্দুকটাও গেল।
উপরি মানে শহুরে শখের শিকারি বাবুদের সঙ্গে গিয়ে যা মিলত।
চাষ আবাদ কিছু কিছু করত, সেটা গিয়েছে। কারখানায় কাজ পেয়েছিল, সেটাও গিয়েছে।