পান নিয়ে চিবোতে চিবোতে জিজ্ঞাসা করে, দেহটা বুঝি ভালো যায় না?
না। হাসপাতাল থেকে খালাস পেয়ে এলাম খবর রাখ না বুঝি মাসি?
খবর রাখি বলেই তো দেখতে এলাম রে। মেয়েরা আসতে শুরু করে।
সকলের আগে আগে নকুলের বৌ পঁচী, প্রায় পিছনে পিছনে তার শাশুড়ি আর মণ্টার মা। মণ্টার বৌ, বোন, মাসি একসাথে এসে গোবর-লেপা মেঝেতেই ঘপ্ ঘপ্ করে বসে পড়ে এইটুকু আসতেই যেন বড় শ্রান্ত হয়ে পড়েছে।
তারপর পাঁচটি ছেলেমেয়ের মা সুখের বৌ লক্ষ্মীকে গটগট করে ঘরে ঢুকে প্রায় লখার মার গা ঘেঁষে পাটিতে বসে পড়তে দেখে গোড়ায় মাথাটা ঘুরে যায় গৌরীর, তারপর রাগে গা জ্বালা করে।
এটা যেন ওর ঘরদুয়ার। যার স্বামী পিছন থেকে এই সেদিন ঘরের চালা জ্বালিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছিল সে কিনা এমন তেজের সঙ্গে নতুন ছাওয়া সেই পোড়া ঘরটাতে ঢুকে এমনভাবে জাকিয়ে বসতে পারে? কে জানে এরা কি দরের মানুষ!
লক্ষ্মী একটু নম্ৰভাবে লজ্জিতভাবে এলে, তার সঙ্গে দু-একটা কথা বলে দশজনের মধ্যে বসলে সুখের অপরাধের জন্য তাকে কিছুমাত্র দায়ী করার কথা গৌরী ভাবতেও পারত না–রাগে গা জ্বালা করা তো দূরের কথা।
প্রায় বছর বছর বিইয়ে বেচারা পাঁচটি বাচ্চার মা হয়েছে–কোলেরটির বয়স বছর খানেক, আবার পোয়াতি হয়েছে সন্দেহ হয়।
স্বামীর কোনো অপকর্মের সঙ্গে কি ওকে জড়ানো যায়!
আরো কয়েক জন হাজির হয় আধঘণ্টার মধ্যে।
দেহের ভারে যেন বড়ই কাতর এমনিভাবে হাতে ভর দিয়ে উঠে লখার মা বাইরে ঘুরে আসতে যায়।
ঘর প্রায় ভরে গিয়েছে। নিজের চালা ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে গৌরীর হঠাৎ খেয়াল হয় যে, তার মতো কমবয়সী মেয়ে বৌ এতগুলি মেয়েলোকের মধ্যে নেই বললেই হয়।
দু-একজন যারা এসেছে, তারা এসেছে শাশুড়ি ননদের আঁচল ধরে, এসে বসেছে শাশুড়ি ননদের পিঠের আড়ালে।
বাইরে ঘুরে এসে লখার মা জঁকিয়ে বসে।
চোখ বুজে আঙুল সঞ্চালন করতে করতে বিড়বিড় করে দুর্বোধ্য কতগুলি শব্দ উচ্চারণ করে।
দু-তিন মিনিটের বেশি নয়।
তারই মধ্যে কয়েকজন সামনে ঝুঁকে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে তাকে প্রণাম করে।
চোখ মেলে এক গাল হেসে লখার মা বলে, কেমন আছ গো নদেরষ্টাদের মা? জ্বরে ভুগছ নাকি? ঘরে ঘরে এই খালি জর আর জ্বর, জ্বরে কাত না হয়ে দুটো-একটা মাস কে যে ঘর-সংসার করছে, কি কাণ্ড বল দিকি? শাউড়ি যদি খাড়া রইল, বৌ ঠিক জ্বরে কাত হবে। এটা কিসের জ্বর, ঘরে ঘরে কেন এত জ্বর, সে কাহিনী জান নাকি গো তোমরা?
ঈশ্বরের কাছে অনেকবার অনেকভাবে শুনে শুনে জ্ঞান জন্মে গিয়েছিল বলেই বোধহয় অন্য সব হিসাব ভুলে গৌরী বলে বসে, এটা তো ম্যালেরি জ্বর মশার কামড় থেকে হয়। ঠেসে কুইনাইন খেলেই নাকি জ্বর সেরে যায়।
তোর জ্বর তবে সারে না কেন?
মোর তো ম্যালেরি জ্বর নয়।
তবে কেন মিছে বকছিল? রাবণ-সীতার জ্বরের কথাটা মোকে বলতে দিবি? না চলে যাব?
গৌরী ভড়কে গিয়ে বলে, চলে যাবে কেন গো মাসি? চলে যেতে বলেছি? তুমি এয়েছ এ তো মোর পরম ভাগ্যের কথা!
লখার মা হেসে বলে, তবে বাজে কথা না বকে, চুপচাপ বোস্ না বাছা?
রাবণ ও সীতার জ্বরের কাহিনী!
বানানো বাজে কাহিনী। অদ্ভুত উদ্ভট কাহিনী বানাতে লখার মার কল্পনার দৌড় কোনোকিছুর ধার ধারে না। একটা নিয়ম শুধু সে মেনে চলে, শ্লীলতার সীমা কখনো সে খুব বেশি ছাড়িয়ে যায় না–যাতে পাকা শাশুড়ি আর কাঁচা বৌ-র একসাথে বসে তার গল্প শোনা মুশকিল হতে পারে।
তবু তার আসরে অল্পবয়সী মেয়ে বৌ বেশি জোটে না কেন লখার মা ভেবে পায় না। তার কল্পনার উদ্ভট দৌড়টাই যে বয়স্কা মা মাসি শাশুড়ি পিসিদের কাছে সরল সহজ সাধারণ অশ্লীলতার চেয়ে অনেক বেশি ভীতিকর, সরস সুন্দর জমকালো সহজ ভাষার সঙ্গে ভাবভঙ্গি মিশিয়ে বলার ধরন ও তার কাহিনী শুনে সমবয়সী মেয়ে বৌয়ের মাথা ঘুরে যাবার আশঙ্কা যে প্ৰায় সকলেই মনে মনে পোষণ করে—এটা আজো লখার মা টের পায় নি।
আজেবাজে কথা তুলে গেীরী গল্প বলায় বাধা সৃষ্টি করেছিল বলে কেউ রাগ করে না। অনেক কাল গল্প শুনছে, সবাই জানে যে, গোড়ায় এরকম একটু বাধা পেলেই লখার মার গলা খোলে, গল্প জমে।
আজকের গল্পের সার কথা হয় এই। রাবণ জগতের সেরা কামুক। ছিচকে লম্পট নয়, কামের মহা শক্তিশালী সাধক। এদিকে সীতাও জগতের সেরা সুন্দরী, সেরা যুবতী, মন্দোদরী কোথায় লাগে! অশোক বনে সীতা, রাক্ষসীরা দিবারাত্রি ঘিরে তাকে পাহারা দেয় আর নানাভাবে তার মন। ভোলাবার চেষ্টা করে। রাবণ পাগল হয়ে ছুটে ছুটে যায়, সীতাকে স্পর্শ করতে পারে না, মারাত্মক অভিশাপের খড়গ মাথায় ঝুলছে। ওদিকে রামের বিরহ সীতাকে অহরহ পোড়াচ্ছে।
এই পর্যন্ত মোটামুটি রামায়ণের মান রেখে লখার মা তার গল্পের গোড়া ফাঁদে, তারপর শুরু হয় তার কল্পনার খাপছাড়া উদ্ভট টানাপড়েন।
কামের জ্বালায় রাবণের এবং বিরহের জ্বালায় সীতার জ্বর হয়। সে জ্বর জগতে আগে ছিল না। ঘন ঘন পালা করে জ্বর আসে। সবচেয়ে আশ্চর্য কথা, দুজনেরই জ্বরের লক্ষণ হয় একরকম। হাড়ের মধ্যে শীত করে সর্বাঙ্গ কাপিয়ে জ্বর আসে, জ্বরের গরম তখন যেন ভেতর থেকে অসংখ্য সুচের মতো মাথা আর গা ছুঁড়ে ছুঁড়ে বেরোতে শুরু করে, তারপর ঘাম দিয়ে জ্বর কমে যায়।
সেই থেকে জগতে ম্যালেরিয়ার শুরু।
ম্যালেরিয়ার পৌরাণিক জন্মকাহিনী শোনাতে বেলা পড়িয়ে আনে লখার মা। কয়েকজন আবার তাকে প্রণাম করে, দু-একটা পয়সা বা কলা মুলো লাউ কুমড়ার ফালি তার সামনে ধরে দেয়। মৃত কার্তিক দাসের বৌকে যারা প্রণাম করতে রাজি নয়, তারাও পয়সা বা এটা ওটা দেয়।