রামা বলে, একবেলায় তোর নতুন ঘর করে দেব। সবাই এলে বলিস।
বলতে বলতে মণ্টা এসে হাজির হয়।
রাগের ভান করে ফেঁচিয়ে বলে, ওরে ও ঈশ্বর তুই যে আকাশের ঈশ্বরকে ছাড়িয়ে গেলি দাদা! মোরা কলে খাটা মজুর মোদের দিয়ে ঘরামির কাজ করিয়ে ছাড়লি!
ঈশ্বরের প্রাণ ঠাণ্ডা হয়েছিল।
সে হেসে বলে, বাজে বকিস কেন? ঘরামির কাজ জানিস যে করবি? মিছে করছিস সব। তোদের তৈরী ঘরে রইতে সাহস হবেনি কো। দমকা একটা হাওয়া ছাড়বে, ছেলেপুলে নিয়ে চাল চাপা পড়ে মরব!
তার ভাব দেখে কথা শুনে সকলেই খুশি হয়।
একটা আশঙ্কা ছিল যে, আচমকা হাঁটাই হয়েও সে যেমন সকলকে তার জন্যে লড়তে দিতে রাজি হয় নি, সকলে মিলে তার পোড়া ঘরটা ঠিক করতে গেলেও সে হয়তো তেমনি দুর্বোধ্য রহস্যময় কারণে বেঁকে বসবে।
হয়তো সে বুঝতেই পারবে না যে, ঘরটা তার খাতিরে ছাওয়া হচ্ছে না–গুণ্ডামির প্রতিবাদ হিসাবে অনেকে মিলে কাজটা করছে।
ঈশ্বর এমন সহজভাবে এটা মেনে নেবে অনেকে ভাবতেও পারে নি।
মামুদ তাকে সাহস দিয়ে সহজ ভাষায় বলে, ভয় নেই, মোরা ঘর ছাইতে জানি। ঝড় বাদলে অন্য দশটা চালা না পড়লে তোর চালাটাও পড়বে না রে ভাই! ঘনরাম হুঁকোয় টান দিতে দিতে উঠে দাঁড়িয়ে কড়া তামাকের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, চারজন জাত ঘরামি আছি, ডরিও না। কদ্দিন আর খাটছি কারখানায়? বাপ দাদার কাছে ঘরামির কাজ শিখেছি।
এক ছিলুমে কুলোয় নি, ঘনরাম আরেক ছিলুম সেজে নিয়ে আগাগোড়া তামাক টানছিল। ঘরামির কাজ অনিশ্চিত। বছরে কোনো সময় কাজের চাপে তার নাওয়াখাওয়া ঠিক থাকে না, আবার কোনো সময় বেশ কিছুদিন কেউ তাকে ডেকেও জিজ্ঞাসা করে না।
ক্লাবঘরটা বিশেষভাবে ছেয়ে দেবার ব্যাপারে তার কাজের নমুনা দেখে কর্তাব্যক্তিরা খুশি হয়েছিল।
সারা বছর নিয়মিত রোজগারের একটা ভালো কাজ সে অনায়াসেই বাগাতে পারত, কর্তাব্যক্তিরা খুশি হলে কি না হয়।
কিন্তু বাপ দাদার পেশা ছেড়ে সে কারখানায় কাজ নিতে রাজি হয় নি।
জন্ম থেকে যে কাজের অন্ধি সন্ধি জেনেছে সেই কাজটাই সম্বল করে আছে আর বাপ দাদার কো টানাটাও আঁকড়ে ধরে আছে।
থেলোহঁকো, ছোট কল্কি, ঘরের উনানে পোড়নো কাঠের কয়লা–জলে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে নেওয়া।
সেই কয়লার আগুনে ঘরে তৈরী শুকনো কড়া দা-কাটা তামাক সেজে টানা।
ঘুমের সময়টা বন্ধ থাকে, কাজের সময় ফাঁকে ফাঁকে চলে, অবসরের সময়টা এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ থাকে না।
তার বৌ বেঙী বলে, মোকে ছাড়বে তবু হুঁকো ছাড়তে পারবে গো।
গৌরীর চেয়ে কম হবে না বেঙীর বয়স কিন্তু ছেলেপুলে হয় নি বলেই বোধহয় তাকে মনে হয় অল্পবয়সী অতি-যুবতী মেয়ে।
সেটা একটা কারণ বটে। কিন্তু কারণটার ওই একটা দিকই লোকে হিসাবে ধরে মাতৃত্ব এসে দৈহিক পরিবর্তন ঘটায় নি। ছেলেমেয়ের ঝঞাট নেই বলে বেঙী যে ভালো মন্দ খেতে পায়, কম অসুখে ভোগে, কম খেয়ে বেশি ঝঞাট পোয়াবার ধার ধারে না এটা কেউ খেয়াল করে না।
কিন্তু বেঙীর উৎকণ্ঠা ক্রমে ক্রমে রূপ নিচ্ছে। আর কদিন চেহারার এই জলুস বজায় থাকবে?
সে তো হাড়ে মজ্জায় জানে মা না হতে পারাটাই কত বড় একটা রোগ। প্রথম যৌবনে চাপা ছিল, ভালো করে টেরও পায় নি। লোকে বাইরের জলুসটাই আজো দেখছে, দিন দিন দেহ মনে সে যে কি বিষম বিপর্যয়ের লক্ষণ টের পেতে শুরু করেছে, লোকে তো তার হিসাব রাখে না!
০৬. মানুষ নাকি সুখে দুঃখে বাঁচে
মানুষ নাকি সুখে দুঃখে বাঁচে। সুখ আর দুঃখ নিয়ে মানুষের বাঁচার কারবার।
কথাটা সত্যি।
এই বন্য এলাকার বেশিরভাগ মানুষ নইলে কি এত বেশি দুঃখের সঙ্গে ছিটেফেঁটা সুখের ভেজাল দিয়ে বংশানুক্রমে বাঁচত!
মুশকিল এই যে, মানুষ কেন বাঁচে কেন মরে এই প্রশ্ন থেকে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড কেন চলে কিভাবে চলে এই সব প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামিয়ে ঘামিয়ে যাদের জ্ঞানী গুণী বিদ্বান হতে হয়, মানুষের সুখ দুঃখের সাধারণ হিসাব নিকাশ তাদের কাছে বড়ই জটিল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ এলাকার বেশিরভাগ মানুষ যারা একটুখানি সুখ আর অনেকখানি দুঃখ সম্বল করে বাঁচে, সুখ দুঃখের সহজ সরল স্পষ্ট মানে জেনেও তারা তাই ওপরতলার ওদের কর্তালিতে জীবনরহস্য ভেদ করার অক্ষমতায় বিনম্র বিভ্রান্ত হয়ে বিশ্বাস করে যে, সুখ দুঃখের মানে বোঝার চেষ্টা করাটাও আগেকার চোদ্দ পুরুষের মতো তাদের পক্ষেও মহাপাপ।
লখার মা গেঁয়ো ভাষায় এই গূঢ় তত্ত্বকথা গাঁয়ের মেয়েদের বোঝাবার চেষ্টা করে।
মেয়েরা তত্ত্বকথাটা বুঝুক না বুঝুক, তার কথার তাৎপর্য বোঝে।
বোঝে কিন্তু সুখ দুঃখের মানে বুঝেও না বোঝার মতো আসল মানেটা গুলিয়ে ফেলে।
লখার মা মাঝবয়সী। যৌবনে নিশ্চয় ভাটা শুরু হবে দু-চার বছরের মধ্যেই। গায়ের রং চোখ-জুড়ানো স্নিগ্ধ-রকম কালো।
ফর্সা একখানা থান ধুতি পরে সে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়, পুরাণ রূপকথার নজির তুলে তুলে গেঁয়ো ভাষায় মেয়েদের বড় বড় দার্শনিক প্রশ্নের রসালো ব্যাখ্যা শোনায়।
সেদিন দুপুরে গৌরীর ঘরে গিয়ে হাজির।
মাজার টনটনানি কাবু করে ফেলেছিল গৌরীকে। তবু সে ব্যস্তসমস্ত হয়ে ওঠে। বেতের মোটা চাচিতে বোনা সস্তা পাটি পেতে তাকে বসতে দেয়।
একটিমাত্র পান ছিল ঘরে, পানটি সেজে সমের সঙ্গে লখার মার হাতে তুলে দেয়।
একফেরতা ফর্সা থান ধুতি পরা লখার মা পিঠে একরাশি চুল ছড়িয়ে আঁকিয়ে বসেছে।