আজিজ চেঁচিয়ে বলে, ব্যাপার আন্দাজ করা যায় না? ছাঁটাই হয়েছে, হামলা চলেছে, তার মানেই মালিকদের সাথে ঠোকাঠুকি। বোকামি করে বিপাকে পড়তে পারে, কোনো গোলমালও করে থাকতে পারে। কিন্তু ভাই, সোজা কথা জিজ্ঞেস করি তোমাদের।–সত্যিকারের বেআইনী। খারাপ কাজ কিছু করে থাকলে পুলিশ দিয়ে জেলে না পাঠিয়ে তলায় তলায় অ্যাতত হ্যাঙ্গামা করত?
নকুল বলে, বজ্ঞাতি করে নি, বোকামিই করেছে। হাড়ে মজ্জায় চোদ্দ-পুরুষের চাষা তো!
নকুলও চাষী ছিল। তবে একযুগের বেশি অর্থাৎ চোদ্দ-পনের বছর আগে।
কয়েকদিন সময় লাগে সকলের মনের ভাব বদল হয়ে যেতে। কিন্তু সকলে যে সচেতনভাবে সক্রিয়ভাবে তার পক্ষ নিয়ে দাঁড়াচ্ছে সেটা টের পেতে দেরি হয় না।
শুধু পথেঘাটে ঘটনাচক্রে দেখা হলেই নয়, অনেক দূর থেকে বাড়ি বয়ে এসেও কত মানুষ যে আফসোস ও সহানুভূতি জানিয়ে যেতে আরম্ভ করেছে।
একদিন শেষরাতে খড় বাঁশ বোঝাই গরুর গাড়ি এসে পোড়া চালাটার পাশে থামে।
সঙ্গে এসেছে জন পনের জোয়ান প্রৌঢ় মানুষ।
ঈশ্বর ঘুমোচ্ছল। গৌরী তাকে জাগিয়ে খবরটা জানাতে সে হকচকিয়ে যায়। এ আবার কিভাবে কিসের নতুন হামলা শুরু হল কে জানে?
সাধুর গলার আওয়াজ শুনে সে ভরসা পায়।
বাইরে যেতেই সাধু বলে, সবাই মিলেমিশে ঘরটা ছেয়ে দিতে এসেছি ঈশ্বর। তা সে পরের কথা পরে হবে, ভালো করে ভোর হোক।
তারপর একটা বিড়ি বার করে সংশয়ভরে বলে, বিড়ি ধরাবার আগুন হবে? বৌমাকে সেঁকটেক দেবার জন্য আগুন যদি করে রেখে থাক–
বয়সে কতই আর বড় হবে সাধু, পাঁচ সাত বছরের বেশি নয়–চেহারাটা অতি বেশি বুড়িয়ে গিয়েছে। অর্ধেক দাঁত পড়ে গিয়েছে, অর্ধেক চুলে পাক ধরেছে।
তারই জোরে সে প্রায় সমবয়সী লোকের সঙ্গেও বাপ জ্যাঠার মতো ব্যবহার করে, অবাধে। ঈশ্বরের বৌকে বৌমা বলতে পারে।
আগুন ছিল না, ব্যবস্থা ছিল। যখন তখন আগুন করে গৌরীকে সেঁক দিতে দরকার হয় বলেই বিড়ি না কিনেও ঈশ্বরকে দেশলাই কিনতে হয়। খোলা আকাশের নিচে কাঠের পিঁড়িতে বসে সাধু বিড়ি ফোঁকে, অন্য সকলে তাকে ঘিরে উবু হয়ে বসে।
সকলেই ঈশ্বরের চেনা মানুষ, বেশিরভাগ কারখানার লোক। এলোমেলো কথা চলে, কিন্তু ঈশ্বরের উপর হামলা হল কেন, তার ঘর পুড়ল কেন এসব প্রশ্নের ধারকাছ দিয়েও কেউ যায় না। সবাই মিলে চাঁদা তুলে বাঁশ খড় যোগাড় করে নিজেরা খেটে তার পোড়া ঘর ছেয়ে দেওয়া যেন একান্ত সহজ ও স্বাভাবিক ব্যাপার। যে কথাটা সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে ঈশ্বরের মনে সেটা সে জোর করে চেপে রাখে। কে জানে তার অবস্থা বিচার-বিবেচনা না করেই ওরা মাতব্বরি করে তার ঘরটা ছেয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছে কিনা।
খাটুনির দাম ওরা চাইবে না। তার ঘরটা নতুন করে দেবার জন্যই ছুটির দিনে ওরা দল বেঁধে এসেছে–আরো কয়েকজন নাকি আসবে।
কিন্তু তার যে পাইপয়সা সম্বল নেই, বাঁশ খড়ের দাম দেবার সাধ্য নেই, এটা ওরা হিসাব করেছে?
পাতলা জ্যোত্স মেশানো আকাশের অন্ধকার ধীরে ধীরে আরো পাতলা হয়ে আসতে শুরু করে। পোড়া ঘরটার পুবের ডোবাটার ওপাশের বাঁশবনে একদল শিয়াল হঠাৎ সমস্বরে প্রচণ্ড শোরগোল তুলে আবার হঠাৎ থেমে যায়।
একে একে আরো কয়েকজন এসে হাজির হয়। তাদের মধ্যে পাকা ঘরামি ঘনরামকে দেখে কয়েকবার ঈশ্বরের চোখে পলক পড়ে না।
সাধু তাকে ডেকে বসায়, একটা বিড়ি দেয়।
বিড়ি ধরিয়ে ঘনরাম ঈশ্বরকে বলে, বিড়ি কুঁকতে কি ভালো লাগে? এক ছিলিম তামাক ঘরে নেই ঈশ্বর?
ঈশ্বর বলে, দিচ্ছি।
খানিকটা কড়া দা-কাটা তামাক যোগাড় করা কঠিন নয়। ছোট বড় পুরোনো দুটো কোও ঘরে আছে।
গৌরীকে সেঁক দেবার মালসা থেকে কয়লা তুলে দু ছিলিম তামাক সেজে দুটো হুঁকো এনে দিলে সাধু আর ঘনরাম পরম আরামে টানতে শুরু করে।
জলহীন হুঁকো।
তা হোক। ওটা অভ্যাস আছে।
তামাকে মজে গিয়ে সাধু ঘনরামকে জিজ্ঞাসা করে, একদিনে উঠবে তো চালাটা?
ঘনরাম হুঁকোয় লম্বা টান দিয়ে কাশতে কাশতে কফ তুলে বলে, এতজন খাটুয়ে মানুষ এয়েচ, একদিনে একটা চালা তুলে দিতে পারব না? তবে কিনা তোমরা সবাই আনাড়ি।
যেমন বলবে তেমনি করব।
তাতেই কি হয় রে দাদা? সব কাজ শিখতে হয়।
খানিক পরেই ঘর ছাওয়ার কাজ শুরু হয়ে যাবে। ঈশ্বর মরিয়া হয়ে সাধুকে জিজ্ঞাসা করে, খরচার ব্যবস্থাটা কী হবে?
সাধু কয়েকবার কেশে গলা খাকারি দিয়ে নিয়ে গম্ভীর আওয়াজে বলে, তার মানে? তোমার ঘর ছাওয়া হবে, খরচা দেবে তুমি! বাঁশ খড় দড়ির দামটা শুধু দেবে, আমরা মজুরি নেব না।
কয়েকজন সশব্দে হেসে ওঠায় ঈশ্বর পরম স্বস্তি বোধ করে।
বুড়ো রামা বলে, অত ঘাবড়ে যাস নে বাবা, খরচাটা মোরা চাঁদা করে তুলেছি। সবাই মোরা হিসেব করলাম কি জানিস? আজ তোর ঘর পুড়িয়েছে, কাল মোদের ঘর পোড়াবে। তুই পিছিয়ে গেলি, বললি যে ভেতরে অনেক কাণ্ড আছে তাইতে মোরা চুপ করে গেলাম। কিন্তু চুপ। করে গেলে তো চলবে না বাবা! দোষঘাট করে থাকিস, আইন আদালত খোলা আছে, গুণ্ডা লাগিয়ে হামলা করা কেন? চাঁদা তুলে ঘরটা ছেয়ে দিয়ে জানিয়ে দেব, এটা মোরা মানলাম না।
সাধু বলে, আরো অনেকে আসবে। গোয়ালঘরে গুমরে মরিস, খবর তো রাখিস না। চাঁদা তুলতে হৈচৈ চালিয়েছি তার কি কোনো দরকার ছিল? হা শুধু সকলকে জানিয়ে দেবার জন্যে। এমনি আইন থাকতে মোরা গুণ্ডা আইন মানব না।
ঈশ্বর বলে, আইন জানি না, মুখ মানুষ। মন যা বলে তাই করি। তোমাদের যদি জানিয়ে দিতাম ব্যাপারটা!