দু মাস পরে খানিকটা সেরে উঠে গৌরী ঘরে ফেরে। ঘর? না, ঘর ছাওয়া হয় নি ঈশ্বরের। আগুনে ঝলসানো কালচে-মারা মাটির দেয়াল শুধু দাঁড়িয়ে আছে।
ভাগ্যে গোয়ালের চালাটা বেঁচেছিল। ভাগ্যে ঈশ্বরের গরু নেই। গরু থাকলে বেচারাকে গাছতলায় ঠেলে দিয়ে তাদের ওই চালায় আশ্রয় নিতে হত।
সেরে উঠতে শুরু করে হাসপাতাল থেকে বিদায় হয়ে এসে গৌরীও ওই চালার কোণে আশ্রয় নেয়।
বুড়ি মা আর পিসিকে মণ্টা তার ঘরে রাত্রে শুতে দিচ্ছে তাই রক্ষা।
মরতে হবেই এ ভয় গৌরীর আর নেই। সেরে ওঠে নি, সেরে উঠবে ধরে নেওয়া হয়েছে কিন্তু সুনিশ্চিত মরণটা অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছে গৌরীর।
বেঁচে যাবে এটা আশা করা চলে।
তাতেই কৃতজ্ঞতার সীমা নেই গৌরীর।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গোয়ালের চালার ঘরে নিচু নোংরা ভিজে কাদাটে ভিটেয় খড়। বিছিয়ে উঁচু গদি করা দেড় হাত চওড়া হেঁড়া কাঁথার বিছানায় শুয়ে সে খানিকক্ষণ দম নেয়, নিজেকে সামলায়। তারপর প্রায় গদগদ ভাষায় জিজ্ঞাসা করে, হ গো, এবারে তো ঘরে এয়েছি, এবার মোকে খুলে বল না, পাঁচ শ টাকা কোথা থেকে পেলে? কী করে মোর প্রাণ বাঁচালে?
পোড়া ঘরটার দিকে বারেক তাকিয়েছিল গৌরী? ওমা, ঘর পুড়লে নগদ টাকা জোটে নাকি? সরকার থেকে দেয়?
পাগল হয়েছিস? বড়লোকের কাছ থেকে টাকা বাগালে ঘর পোড়। ঘর পুড়েছে, একদম খালি গোয়ালঘরে শুয়ে আছিস, সেটা খেয়াল করেছিস?
গায়ের আঘাতের কয়েকটা চিহ্ন আজো মিলিয়ে যায় নি–মাথার ক্ষত চিহ্নটা কোনোদিন মিলোবে না।
ঈশ্বর সেগুলি গৌরীকে দেখায় কিন্তু আসল ঘটনাটা তাকে জানায় না। মেয়েমানুষের মুখের আগল নেই, গৌরীকে ব্যাপারটা সবিস্তারে জানালে বাঘ মারার ব্যাপারে দুজনের কাছে টাকা নিয়ে তার দুজনকে ঠকানোর কীর্তিকাহিনী সবাই জেনে যাবে।
গৌরী মনে করবে এটা তার মস্ত বাহাদুরির কথা!
গৌরীকে সে শুধু বলে যে, বাঘটা মারার জন্য পাঁচশ টাকা পুরস্কার পেয়েছে।
০৫. অদ্ভুত বর্ষা
কী অদ্ভুত বর্ষাই এবার হল।
অনাবৃষ্টিতে মরে গেল বেশিরভাগ চারা ফসল। যারা পারল তারা আবার চাষ করল, যারা পারল না তারা কেবল কপাল চাপড়াল।
তারপর অতিবৃষ্টির বন্যায় সে ফসলও গেল পচে।
ঈশ্বর কোনো কারখানায় কাজ পায় নি।
বাড়াবাড়ি করলে পাছে সব জানাজানি হয়ে যায় এই আশঙ্কাতেই বোধহয় ঈশ্বরের ওপর সোজাসুজি আরো বেশি হামলা করতে বারণ করে প্রভাস ও রবার্টসন সুখেকে ইঙ্গিত দিয়েছিল। বিশেষত চারিদিকে যখন দুর্ভিক্ষের কাল ছায়া ঘনিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে।
শাস্তি যা পেয়েছে তা অবশ্য তাদের বিচারে যথেষ্ট নয়। ওকে গুলি করে মারলে কিংবা কমপক্ষে ফাসি দিলে গায়ের জ্বালা খানিকটা মিটত।
কিন্তু দুজনে পরামর্শ করেই একমত হয় যে, বাঘ মারার ব্যাপারটা নিয়ে এখন আর ওরকম শাস্তি দেবার জন্য বেশি বাড়াবাড়ি না করাই ভালো।
যে দিনকাল!
ঈশ্বরকে যেদিন কারখানায় ঢুকতে দেওয়া হয় নি, সেদিন গেটের সামনে তাকে ঘিরে কারখানার লোকেরা ভিড় করেছিল, ভেতরে যারা ঢুকেছিল তারাও প্রায় সকলেই বেরিয়ে এসেছিল। আধঘণ্টা ঈশ্বরকে নিয়ে হৈচৈ করে সকলে আবার কেন শান্তভাবে কারখানায় ঢুকেছিল, লেট মেনে নিয়ে বাড়তি টাইম খেটে সেটা শোধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার মানে আজ পর্যন্ত প্রভাস রবার্টসনদের মাথায় ঢেকে নি।
ভয় পেয়ে তারা পুলিশ ডেকেছিল। পুলিশের ভয়ে যে তারা ঈশ্বরকে ছাঁটাই করা নিয়ে হাঙ্গামা করার ইচ্ছা ত্যাগ করে শান্ত শিষ্ট সুবোধ বালকের মতো মাথা নিচু করে কারখানায় ঢুকেছিলেন–এটা কল্পনা করতে ভালো লাগলেও বিশ্বাস করার মতো বোকা তারা নয়।
ভাড়াটে লোকের কাছে খুঁটিনাটি সব রিপোর্ট পেয়েছে। ভাড়াটে বলেই কোনো একজনের উপর তারা আস্থা রাখতে পারে না–দলে ভিড়ে ব্যাপার জেনে চুপিচুপি জানাবার জন্য চার-পাঁচ জনকে পৃথক পৃথক ভাবে কাজে লাগায়।
অনেক সময় অবশ্য তারা বুঝে উঠতে পারে না কার রিপোর্টটা বিশ্বাসযোগ্য, নির্ভরযোগ্য।
সুখে চুপচাপ থাকে কিন্তু তার খবর বরাবর সঠিক হয় বলে তাকে তারা এত বিশ্বাস করে।
ঈশ্বরের ব্যাপার সম্পর্কে সকলের রিপোর্ট ছিল একরকম কিন্তু ঘটনার আসল তাৎপর্য তারা ধরতে পারে নি।
ঈশ্বরের পক্ষ কেউ টানছে না। সুখে তাকে গুপ্তা দিয়ে মেরে প্রায় ঘায়েল করে, তার যথাসর্বস্ব চুরি করায়, তার ঘরের চালায় আগুন লাগায়–দু-চারজন সহানুভূতি জানাতে গেলেও সকলে যেন উদাসীন হয়ে থাকে।
কিন্তু রিপোর্ট এসেছে, আজিজ সাধু মণ্টারা উঠেপড়ে সকলকে বোঝাচ্ছে–ঈশ্বরের অপরাধটা নাকি শুধু ক্ষমার যোগ্য নয়, তুচ্ছ করে উড়িয়ে দিয়ে ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করাই নাকি সকলের কর্তব্য।
ওরা নাকি সকলকে বোঝাচ্ছেন না, মানুষটা খুঁটি আছে বুঝতে পার না তোমরা? বৌ হাসপাতালে মরছে, হঠাৎ ছাঁটাই হয়ে গেল। সবাই মোরা লড়তে চাইলাম, কিছুতে স্বীকার করল। না। কি বলেছিল মনে নাই? ভেতরে অন্য ব্যাপার আছে, তোমাদের জড়াব না ভাই। কথাটা সরলভাবে না বললে ওর জন্য লড়তে নেমে হয়তো সবাই মোরা বেকুব বনে যেম।
প্রশ্ন ওঠে ভেতরে কি ব্যাপার আছে? খুলে বলে না কেন?
সাধু জোর করে বলে, গোপন কিছু হবে খুলে বলা যায় না। নিজের কোনো বোকামি হতে পারে। সেটা ওর নিজের ব্যাপার, ও নিজে বুঝবে। তুমি আমি হিসেবে ধরব, ওই অবস্থায় মানুষটা মোদের ধাপ্পা দেয় নি, মুশকিলে ফেলে নি।