ঈশ্বর এভাবে ও-ভাবে রেহাই পাবার চেষ্টা করে। একবার বলে বড়ই তার অপমান বোধ হয়েছে, এখানে আর সে কাজ করবে না। তারপর বলে যে, অন্য জায়গায় বেশি মজুরিতে ভালো কাজ পাবে, ছাঁটাই হয়ে ভালোই হয়েছে। আবার বলে যে খাটুনি তার পোষায় না, এবার সে একটা দোকান দেবে।
তার দিশেহারা ভাব বেশ খানিকটা হকচকিয়ে দেয় সকলকে। খেয়ালের বশে অন্যায় করে সায়েব তার কারখানায় ঢোকা নিষেধ করে হুকুম দিয়েছে বলে মজুর কেরানি সকলে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, তাকে সাথে না নিয়ে একজনও কারখানায় ঢুকবে না স্থির করেছে–তার এমন কাচুমাচু দিশেহারা ভাব, সকলে তার পক্ষ নিয়ে লড়াই করবে তাতে এমন ঘোরতর আপত্তি!
কাজ শুরু করার টাইম পেরিয়ে আধঘণ্টা কেটে যায়, কাজ শুরু করা যায় না।
ইতিমধ্যে দেখা যায় যেন মন্ত্রবলে একদল পুলিশ এসে সেজেগুজে তৈরি হয়ে দাঁড়িয়েছে অদূরে কদমগাছটার তলায়।
কয়েকজনকে ঠেলে সরিয়ে নন্দ এগিয়ে যায়, ঈশ্বরের মুখের কাছে মুখ নিয়ে শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে, তোমার মতলবটা কি ঈশ্বর? তুমি কাদের এজেন্ট?
প্ৰাণ ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল ঈশ্বরের। সে হঠাৎ মুখ তুলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে, ভাই সব, কাজে যাও না তোমরা। বার বার বলছি, তোমরা শুনছ না। আমার ছাঁটাইয়ের মধ্যে অন্য ব্যাপার আছে–তোমাদের আমি তার মধ্যে জড়াব না।
মণ্টা বাঘের মতো থাবা উঁচিয়ে গর্জন করে বলে, এ কথাটা গোড়ায় বললেই হত না। হারামজাদা?
নন্দ তাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে যায়।
হৈচৈ কলরব নয়, পরস্পরের কথা বলাবলির একটা গুঞ্জনধ্বনি তুলে ভিড়টা কাজ করতে কারখানায় ঢুকতে শুরু করে।
প্রায় পৌঁনে এক ঘণ্টা লেট হয়েছে সকলের। কিন্তু বড়ই আশ্চর্যের বিষয় যে, লেটটা হাজিরার হিসাবে গণ্য করা হয় না।
সবাই ঠিক টাইমে কাজে যোগ দিয়েছে এটাই অফিসিয়ালি ধরে নেওয়া হয়।
গুরুতর হাঙ্গামার আশঙ্কা জেগেছিল, এত অল্পে বিনা হাঙ্গামায় সেটা বাতিল হয়ে যাবে বড় কর্তারা কেন ছোট কর্তারাও সেটা ভাবতে পারে নি।
সকলকে তাই জানিয়ে দেওয়া হয় যে, বিশেষ অবস্থা বিবেচনা করে কারো লেট হাজিরায় ধরা হয় নি, তবে এক ঘণ্টা ওভারটাইম খেটে দিয়ে ওটা তাদের পুষিয়ে দিতে হবে।
আজিজ হেসে বলে, নিজেদের হিসাবটা ঠিক রাখে। লেট করেছ, মাপ করলাম, বিনা পয়সায় ওভারটাইম খেটে সেটুকু শোধ করে দিয়ে যেও!
যেন নেশা করেছিল, ঘোর কেটে যাচ্ছে এমনিভাবে স্থলিতপদে ঈশ্বর হাসপাতালে যায়। সকালে দেখা করার সময় পার হয়ে গিয়েছিল, তাকে বিকালে যেতে বলা হয়।
বিকালে হাসপাতালে গৌরীকে দেখতে যাবার পথে ঈশ্বর একেবারে সামনাসামনি পড়ে যায় কথায় মশগুল পাশাপাশি হন্টনরত প্রভাস আর রবার্টসনের।
একজন টানছে সিগার, অন্যজন ফুঁকছে সিগারেট।
অনায়াসে পাশের কচু কলা বাঁশ বনের আড়ালে চলে যেতে পারত ঈশ্বর ছোট ছেলেও লাফ দিয়ে পার হয়ে যেতে পারে পথের ধারের ময়লা কাদায় বুজে আসা নালাটা।
কিন্তু সে যেমন চলছিল তেমনিভাবে চলতে থাকে। কথা কইতে কইতেই প্রভাস ও রবার্টসন তার দিকে এক নজর তাকিয়ে চলে যায়।
দুজনের বিবাদ শুধু মিটে যায় নি, ভাবও হয়েছে। তারই জন্য সন্দেহ নেই।
কী মজার কাগুই না জানি হয়েছিল। তার দলিলের জোরে দুজনেই কি সকলের সামনে আবার বাঘ মারার দাবি ঘোষণা করেছিল এবং একটা হাস্যকর অবস্থা সৃষ্টি করে অপদস্থ হয়েছিল? দুজনকেই সে সমান জোরের সঙ্গে বাঘ মারার সার্টিফিকেট লিখে দিয়েছিল।
ঘটনা সে জানতে পারে অনেক কিছু ঘটবার পর। হাসপাতালে গৌরীকে দেখে ঘরে ফেরার পথের নির্জন স্থানে কয়েকজন অচেনা লোকের হাতে সে এমন বেদম মার খায় যে, কয়েকদিনের জন্য বিছানা নিতে হয়।
তার যথাসর্বস্ব যৎসামান্য–একদিন রাত্রে সবই প্রায় চুরি হয়ে যায়।
কদিন পরে পুড়ে ছাই হয়ে যায় তার তিনপুরুষের ঘরের চালা।
এসব অবশ্য সুখের কীর্তি।
কিন্তু প্রভাস ও রবার্টসন সোজাসুজি প্রতিশোধের ব্যবস্থা না করলে সুখের পক্ষে এত কাণ্ড করা সম্ভব হত না।
প্রভাসের বসার ঘরে সুখেন্দুকে ডাকিয়ে এনে দাঁড় করিয়ে রেখে বেয়ারা পেগ দিয়ে গেলে গ্লাসে গ্লাসে ঠেকিয়ে চুমুক দিয়ে দুজনে কয়েক মিনিট কথা বলেছিল। তারপর রবার্টসন সুখেকে ধমক দিতে শুরু করেই মেজাজ চড়ে যাওয়ায় তার গালে মেরে বসেছিল একটা চড়।
রবার্টসনের মোটা কড়া থাবা। বেহিসাবী রাগের মাথায় চড় কমিয়ে দিয়ে থাকলে গালটা সুখের ফেটে যেত।
গালটা জ্বলেপুড়ে গেলেও সুখে টের পেয়েছিল, চড়টা হিসাব করে মারা, তাকে একেবারে ঘায়েল করার উদ্দেশ্য সায়েবের নেই।
তাকে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গ্লাসে আরেকটা চুমুক দিয়ে রবার্টসন অদ্ভুতরকম শান্ত গলায় সংক্ষেপে ব্যাপারটা তাকে জানিয়েছিল।
এবং ভয়ানক শাস্তির ভয় দেখিয়েছিল।
সুখে কাচুমাচু করে নি, ধীর গম্ভীরভাবে সবিনয়ে জানিয়েছিল, ঈশ্বর যে এমন বদমাশি করবে তার জানা ছিল না। ওকে সে শায়েস্তা করে দেবে।
প্রভাস বলেছিল, ওকে শায়েস্তা করার জন্য আমাদের কাছে থেকে আবার দু-পাঁচ শ আদায় করবে তো?
আজ্ঞে না। একটা পয়সাও চাইব না। রবার্টসন যেন জমে আসা নেশার ঝোঁকেই বলেছিল, গেট আউট, শূয়ারকা বাচ্চা।
সুখে কিন্তু টের পেয়েছিল যে, গালে চড় মারার মতো এটাও সায়েবের হিসাব করে দেখানো মেজাজ। অর্থ অতি পরিষ্কার।
তাকে একেবারে বাতিল করে বাদ দেবার ইচ্ছা সায়েবের নেই, কিন্তু এ ব্যাপারে হাতেনাতে সে কি করে আগে সায়েব সেটা দেখবে। নইলে আর খাতির নেই।