প্রভাস গম্ভীর হয়ে একটু ভাবে। তার মুখের গুমোট ভাব দেখে ঈশ্বরের রীতিমতো শঙ্কা জাগে যে, লোকজন ডেকে তাকে মারধর করে খেদিয়ে না দেওয়া হয়।
প্রভাস কিন্তু সংক্ষেপে শুধু জিজ্ঞাসা করে, সবটা নগদ চাই?
ঈশ্বর বলে, হা বাবু, চিকিচ্ছের ব্যাপার, প্রাণ নিয়ে টানাটানি তার গরিব চাষী মজুর মানুষ। সব খরচটা নগদ আছে না দেখলে বাবুরা চিকিচ্ছে রুই করবে না।
প্রভাস বলে, একটু বস তাহলে। অত নগদ ঘরে নেই, যোগাড় করে আনি। এই খসড়াটা নিজের হাতে ততক্ষণে লিখে ফ্যালো–আমি ফিরে এলে সামনে সই করে দেবে।
প্রভাসের আগে থেকে তৈরি করা ফুলস্কেপের দেড়পাতা খসড়াটা কাঁচা হাতের মোটা অক্ষরে কপি করতে করতে ঈশ্বরের বুক কঁপে, প্রাণটা জ্বালা করে।
গৌরী মরবে ধরেই নিয়েছিল। ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করার জন্য চুরিচামারি চালাকিবাজির একটা সুযোগ পেয়েছে বলেই মেনে নেবে?
সুখের দেওয়া ঘুষের টাকাটা পাওয়ায় গৌরীকে হাসপাতালে পাঠানো গিয়েছিল। কিন্তু ও টাকায় কুলোবে না। ওটা ছিল শুধু টাকা পেয়ে নিজের বাঘ-মারার বাহাদুরি ত্যাগ করা।
কিন্তু প্রভাসের কাছে টাকা সে কোন হিসাবে নেবে?
অথচ এটাকাটা না পেলে গৌরীর ফাড়া হয়তো কাটবে না, তাকে বাঁচানো যাবে না।
পিসি দিনরাত কানের কাছে জপ করে বৌটাকে মারিসনে ঈশ্বর মারিসনে। পুরুষমানুষ, চুরি-ডাকাতি করে টাকাটা যোগাড় করে কমাস নয় জেল খাট!
কথাগুলি কানে আর প্রাণে যেন ঝনঝন করে বাজে।
প্রভাসের টাকাটা নিলে গৌরী এবারকার মতো বাঁচবে। তার কপালে কি আছে কে জানে। সব জানবার বুঝবার পর রবার্টসন বা প্রভাস কি ছেড়ে কথা কইবে, তাকে সহজে রেহাই দেবে!
খসড়া কপি করার আগেই প্রভাস ফিরে আসে। নিজের হাতে লেখা দলিলে ঈশ্বর তার সামনে স্বাক্ষর করার পর দশ টাকা পাঁচ টাকার নোট মিলিয়ে প্রভাস আড়াই শ টাকা গুনে তার হাতে দেয়।
সুখেকে দুটো দশ টাকার নোট ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল। প্রভাসকে কিছুই ফিরিয়ে দিতে হয় না।
সায়েব আর সরকারি বাবুদের জন্য বিশেষভাবে তৈরী হাসপাতাল–উপায় নেই বলেই কিছু কিছু সাধারণ মানুষকে ঢুকতে দেওয়া–খরচ নিয়ে।
নিয়মিতভাবে গৌরীকে ঈশ্বর দেখতে যেতে পারে না।
দেখাশোনার টাইম বাঁধা। ঈশ্বরকে তখন কারখানায় আটক থাকতে হয়।
দিন দশেক পরে ঈশ্বর গৌরীকে দুবেলা হাসপাতালে বাধা টাইমে দেখতে যাবার অবাধ অধিকার পায়।
সেদিন ভোর আটটায় কারখানার দরজায় হাজির হলে দারোয়ান রামভজন তার পথ আটকে জানায় যে, কারখানায় ঢাকা তার বারণ।
বড় সায়েব রবার্টসন স্বয়ং হুকুম দিয়েছে।
কা হুয়া ভাই?–রামভজন সহানুভূতির সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে।
ঈশ্বরের জানাই ছিল যে, রেহাই সে পাবে না, গায়ের জ্বালায় প্রভাস আর রবার্টসন দুজনেই আঘাত হানবে।
প্রথম আঘাত দিল রবার্টসন।
ঈশ্বর তার নিজস্ব হিন্দিতে বলে, সাবকো বিবিকা সাথ পিরিত হুয়া, সাবকো তাই গোসা হুয়া।
কি করা উচিত এবং সঙ্গত? ঈশ্বর ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। অন্য মজুরদের জানিয়ে দিতে পারে যে, অকারণে এবং অন্যায়ভাবে তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে লড়াই একটা শুরু করে দিতে পারা যায়।
রবার্টসন আসল ব্যাপার প্রকাশ করবে না, অন্য অজুহাত দেবে সন্দেহ নেই।
কিন্তু ঈশ্বরের বিবেক সাড়া দেয় না।
গৌরীর প্রাণ বাঁচানোর জন্যই হোক আর যে কারণেই হোক ধাপ্পা দিয়ে সে পাঁচ শ টাকা বাগিয়েছে। সেটা গোপন থাকলেও সকলকে তার পক্ষ নিয়ে লড়াইয়ে নামাতে হলে কত মিছে। কথাই যে তাকে বলতে হবে, তার জন্য যারা প্রাণান্তকর দুঃখদুর্দশা বরণ করবে তাদেরও নানাভাবে ধাপ্পা দিতে হবে।
সে-ও তো খুলে বলতে পারবে না আসল ব্যাপার।
আজিজ, নকুল, মণ্টারা জন সাতেক রোজই একসাথে গল্পগুজব করতে করতে কাজে আসে, একজন প্রশ্ন করে, দাঁড়িয়ে যে?
ঈশ্বর মুখ খোলার আগেই রামভজন জানিয়ে দেয়, কাজ তার খতম হয়ে গিয়েছে, বড় সাহেবের হুকুমে।
সাতজনেই দাঁড়িয়ে যায়, পৃথকভাবে আরো দুজন গেটের মধ্যে প্রায় ঢুকে পড়েছিল–তারাও ফিরে এসে সামনে দাঁড়ায়।
কি ব্যাপার?
ঈশ্বরের আধা চাষী আধা মজুর সরল প্ৰাণে কি যে একটা ঝোঁক চাপে, সে বলে বসে, ওই। বাঘ মারার ব্যাপার, আবার কি! সায়েবের গুলি ফস্কে গেল, আমার বন্দুকে বাঘ মরল, এ অপমান কি সয়!
মণ্টা গর্জন করে বলে, বটে! ইয়ার্কি পেয়েছে নাকি! নিজের গুলি ফস্কে গেল, তোর গুলিতে বাঘ মরল, সেই দোষে তোকে ছাঁটাই করবে! তোকে না ঢুকতে দিলে আমরাও আজ কেউ ঢুকব না, যারা ঢুকেছে তারাও সবাই বেরিয়ে আসবে।
আজিজ বলে, ঠিক কথা। যাকে খুশি, যখন খুশি ছাটাই করবে–ইস্!
ঈশ্বর বড়ই বিব্রত হয়ে বলে, যা গে যাক, কাজ আমার জুটে যাবে।
মণ্টা বলে, যা গে যাক্ মানে? কাজ জুটবে কি জুটবে না, মোটেই সে কথা নয়। এরকম খেয়ালখুশির ছাটাই মোরা মানব না–এ ইয়ার্কি চলবে না।
প্রৌঢ় সাধু বলে, বটেই তো, আজ তোকে বিনা দোষে খেদাচ্ছে, কাল মোকে খেদাবে।
কাজ শুরু করার সময় ঘনিয়ে এসেছে। ভো বাজার আওয়াজ শুনে নিখুঁত হিসাবে সময় আন্দাজ করে পিলপিল করে খাটুয়েরা আসতে শুরু করেছে। অনেক দিনের অভ্যাসে আন্দাজ হয়েছে নির্ভুল।
কয়েক মিনিট আগে আসবে। বেশি আগে এসে কাজের পেছনে সময় নষ্ট করার বোকামি তাদের অল্প দিনেই কেটে যায়। বাধা টাইমের ধরাবাঁধা কাজ তো।
দেখতে দেখতে ঈশ্বরকে ঘিরে ভিড় জমে ওঠে। ইতিপূর্বে যারা ভিতরে ঢুকেছিল তারাও হয় খবর পেয়ে নয় টের পেয়ে বেরিয়ে এসে ভিড় বাড়ায়।