সে যেন ক্ষেপে গিয়েছে। সে যেন জামদগ্নির চেয়েও বিশ্রী ভয়ঙ্করভাবে উদ্যত হয়েছে নিজের মাকে খুন করে ফেলার জন্য।
এটা শুধু সঙ্কেত, ইঙ্গিতের ভাষা।
সাধারণ বোমার কেন, এটম বোমার আওয়াজ শোনার শক্তিও যশোদার ফুরিয়ে গিয়েছে।
নিজে রেগে বোমার মতো ফেটে গিয়েও কোনো হুকুম যে মাকে শোনাতে বা বোঝতে পারবে না, ঈশ্বরের তা অনেক বছর থেকে জানা আছে।
এই রকম ইশারায় সে মাকে তার আদেশ নির্দেশ জানায়।
দু-এক দিনের ব্যাপার নয়, কয়েক বছর ঈশ্বর এমনিভাবে পঙ্গু মাকে সামলে চলছে।
গৌরী পারে না।
রাবণের বুক চিরে শিরা-উপশিরা থেকে রক্ত শুষে পান করা বিশেষ এক বীরের মতো যাত্রা দলের সঙের মতো রূপ নিয়ে সামনে রুখে দাঁড়ালেও যশোদা কিছুমাত্র বিচলিত হয় না।
ছেলের শাসনের এই নির্বাক ভঙ্গি তারও অনেক দিনের জানা।
বলে, যাচ্ছি, যাচ্ছি–শুয়ে পড়ছি গিয়ে। একটু দই কিন্তু খাস যোগাড় করে, সব বিচ্ছিরিভাব কেটে যাবে।
ঈশ্বরকে ঘুষ দিয়ে বাগাবার জন্য রবার্টসন সুখেকে কাজে লাগিয়েছিল।
টাকা কিছু বেশি লাগে কিন্তু সহজ সরল উপায়–তাকে কেউ কোনোভাবে দায়ী করতে পারবে না।
ঈশ্বরকে কত টাকা দেবে আর নিজে কত টাকা মারবে–সেটা সুখের হিসাব নিকাশ বিচার বিবেচনা।
তার কাজটা হাসিল করা চাই, এটা সুখে খেয়াল রাখবে।
তার আসল কাজটা হাসিল করার জন্যই যে তার হাতে বিনা রসিদে এতগুলি কড়কড়ে নগদ টাকার নোট তুলে দেওয়া হয়েছে এই সোজা কথাটা একবার ভুলে গেলে তারই ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার হয়ে যাবে, কোনো বিশেষ কাজ হাসিল করার জন্য আর কেউ যে তার হাতে টাকা তুলে দেবে না–এটুকু জ্ঞান সুখের আছে।
নইলে সে তো ঈশ্বরকে প্রায় অর্ধেক বখরা দিতে রাজি হত।
ঘটনা ওইখানে থেমে থাকে না।
প্রভাস এজেণ্ট লাগায় না। ঈশ্বরকে বাড়িতে ডাকিয়ে এনে নিজেই কথা বলে।
বলে, একটা খুব গুরুতর ব্যাপারে তোমায় ডাকিয়েছি। মাথা ঠাণ্ডা করে বস, চা খাবার খাও, তারপর কথাটা তোলা যাবে। খুব জরুরি কথা, গোপনীয় কথা।
বাইরের ঘরে ডেকে বসিয়ে চা খাবার খেতে দিয়ে সমাদর করে তবু ঈশ্বরের এতটুকু কাচুমাচু ভাব না দেখে প্রভাস যেমন আশ্চর্য হয়, তেমনি ক্ষব্ধ হয়!
ছোটলোকেরা এতদিনে সত্যি সত্যি ছোটলোক হয়ে যেতে শুরু করেছে। কবছর আগে তার ফুলের বাগান করার শখ হলে এই ঈশ্বর মালীর কাজ পেয়ে তাকে যেন দেবতা মনে করত, সামনে এলে সেইরকম ভাব দেখাত।
দু মাস পরেই অবশ্য তাকে বিদায় করে অন্য লোক রেখেছিল। জঙ্গল সাফ করতে পারে, মাটি কোপাতে পারে, ফুলের গাছ লাগাতেও পারে কিন্তু দেশী বিলিতি শখের ফুল আর পাতাবাহারের বাগান গড়তে জানে না।
মনে মনে বিরক্ত হলেও প্রভাস বাইরে সে ভাব প্রকাশ করে না। একটু আদেশের সুরে মিষ্টি করেই বলে, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে ঈশ্বর–একটু স্বাৰ্থ ত্যাগ করতে হবে। আমার খাতিরে, এ দেশের লোকের মানের খাতিরে। ওর গুলি বোধহয় দু-তিন ফুট ফাঁক দিয়ে ফস্কে গেল, তবু রবার্টসন বাহাদুরি করবে যে ওই বাঘটা মেরেছে। সায়েব হলেই মস্ত শিকারি হয়, এদেশের লোক বাঘ মারতে পারে না! তোমায় বলতে হবে যে, বাঘটা আমি মেরেছি।
ঈশ্বর বলে, তবেই সেরেছেন!
প্রভাস গম্ভীর হয়ে বলে, না, ছোট সস্তা হিসাব তুমি ধরতে পারবে না। তোমার বন্দুকের গুলিতেই বাঘটা মরেছে সত্যি কিন্তু তুমি এই নিয়ে বাহাদুরি করতে গেলে উল্টো ফল ফলবে। তোমার কথার কেউ দাম দেবে না ওই সায়েব ব্যাটা জোর গলায় বলতে পারবে যে, ওর গুলিতে বাঘ মরেছে। কিন্তু তুমি যদি বল যে, প্রভাসবাবুই বাঘটা মেরেছেন, ও ব্যাটা জব্দ হয়ে যাবে।
ঈশ্বরের মজা লাগে, হাসি পায়। একটা বাঘ মেরেছে বানিয়ে বলতে পারার জন্য রবার্টসন কেন সুখের মারফত তাকে আড়াই শ টাকা দেয় অর্থাৎ আসলে আরো অনেক বেশি টাকা কেন খরচ করে–ভালোমতো বুঝে উঠতে পারছিল না।
এবার ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রভাস ও রবার্টসনের মধ্যে একটা ভয়ানক। ঝগড়া হয়েছিল, প্ৰায় খুনোখুনি ব্যাপার, এ গুজব তার কানেও পৌঁছেছিল কিন্তু তার জানা ছিল না। যে, ওই বাঘ মারা নিয়ে দুজনের বিবাদ বেধেছিল।
হাসি পায়, মজা লাগে–বেশিক্ষণের জন্য নয়। কি করবে ভেবে না পেয়ে তার পরেই ঈশ্বর বিব্রত বোধ করে।
রবার্টসনের টাকা খেয়ে সে যে দলিল লিখে দিয়েছে সে কথা কি প্রভাসকে বলা যায়?
তার জবাবের জন্য খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে প্রভাস বলে, আমি বরং তোমায় কিছু নগদ টাকাও ধরে দিচ্ছি ঈশ্বর। শুনলাম তোমার বৌ নাকি হাসপাতালে গিয়েছে। তুমি শুধু লিখে দেবে যে, আমার গুলিতে বাঘটা মরেছে।
ঈশ্বর খানিকক্ষণ মাথা হেঁট করে ভাবে। তার হৃদয় মনে যে কী আলোড়ন চলছে প্রভাস তা কল্পনাও করতে পারে না। বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেও বিস্ময়ের সঙ্গেই সে ভাবে যে, নগদ টাকা পাবে শুনেও একটা বাঘ মারার বাহাদুরির দাবি ছাড়তে ঈশ্বর ইতস্তত করে!
ঈশ্বর হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে, কত টাকা দেবেন?
তখন খুশি হয়ে প্রভাস বলে, তুমি কত চাও?
ঈশ্বর বলে, আপনাকে খুঁটি কথা বলি। বৌটি হাসপাতালে গিয়েছে, শ পাঁচেক টাকা হলে ওকে বাঁচানো যায়
প্ৰভাস রেগে উঠে সংযম হারিয়ে একটা বিশ্ৰী মন্তব্য করে বসলে সে তাড়াতাড়ি বলে, না না, আপনার কাছে পাঁচ শ টাকা চাইছি না। যা কিছু সম্বল আছে সব বেচে দিয়ে আড়াই শ টাকার। মতো যোগাতে পারব। আপনি যদি আড়াই শ দ্যান তাহলে লিখে দিতে রাজি আছি।