- বইয়ের নামঃ হলুদ নদী সবুজ বন
- লেখকের নামঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ দি স্কাই পাবলিশার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. আকাশে অষ্টমীর চাঁদ
আকাশে অষ্টমীর চাঁদ। একপাশে হেলে পড়ে আছে। পৃথিবীতে তাই আবছা আঁধার। এই আঁধার চোখ মেলে দেখা যায়। সব জীবন্ত প্রাণীর চোখে এই মজার ধাঁধা–খাঁটি অন্ধকার দেখার সাধ্য নেই।
একটু আলো চাই। আঁধার একটু আবছা হওয়া চাই। নইলে চোখ টের পাবে না, অন্ধকারে একেবারেই অন্ধ হয়ে থাকবে।
এখন মাঝরাত্রি পার হয়ে গিয়েছে।
রাত্রি কিন্তু নিঝুম হয় নি। রাত্রিচর পাখি ও পশুর আওয়াজ ঘুমন্ত পৃথিবীতে প্রাণের সাড়া তুলছে, বিচিত্র সে আওয়াজ–মধুর ও কর্কশ।
ওদের যেন জগৎ-সংসারকে জানিয়ে দেবার দায় যে, প্রাণীরা রাত্রির অবসরে একটু শুধু ঘুমিয়েছে, তারা মরে নি, তারা আবার জাগবে।
হঠাৎ প্রায় একসঙ্গে গর্জন করে ওঠে কয়েকটা বন্দুক। একসাথে এমনভাবে মিশে যায় আওয়াজ যে, আন্দাজ করা কঠিন হয় কটা বন্দুক গর্জন করেছে।
প্রকাণ্ড বাঘটা নিঃশব্দেই এসেছিল। যে আবার একঘায়ে গরু মহিষ মানুষের ঘাড় ভেঙে দিতে পারে, এত বড় বাঘ সেই থাবা মাটিতে পেতে হটে কিন্তু শব্দের মৃদুতম কম্পনটুকুও ওঠে না!
গুলি লেগেছে। যেখানে গুলি লাগলে এরকম বাঘও ঘায়েল হয় সেখানেই লেগেছে। আবছা আলোতেও টের পাওয়া যায় যে, গুলি খেয়েই বাঘটা লাফিয়ে লক্ষণের চালায় উঠে চালাটা নিয়ে হুড়মুড় করে আছড়ে পড়ে।
তারপর জ্বলে ওঠে তিনটে পেট্রোম্যাক্স।
সেই আলোয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে পরিবেশ।
খড় বাঁশ শণ মাটির ছাড়া ছাড়া কয়েকটা কুঁড়েঘর, বর্ষায় ভরাট ডোবা শাপলা আর কচুরিপানার ফুলে শোভাময়ী, পাশে বাঁশঝাড় এবং আগাছার জঙ্গল। গোয়ালের চালাটা ভেঙে পড়ে মরা গরুটাকে প্রায় আড়াল করে দিয়েছে–
শেষত্রে এসে গোয়ালের জীর্ণ পুরোনো কঞ্চির বেড়া ভেঙে গরুটাকে মেরে মানুষের সাড়া পেয়ে এই বাঘটাই পালিয়ে গিয়েছিল।
বাঘটা হাত দুই তফাতে পড়ে আছে। সত্যই প্ৰকাণ্ড বাঘ, পূর্ণবয়স্ক আসল বাঘ। পেট্রোম্যাক্সের আলোয় বাঘটার গায়ের রং বহুরূপীর মতোই মনে হয়।
দায়ী ছিল ঈশ্বর।
দ্বিধাগ্রস্ত প্রভাস ও রবার্টসনকে সে-ই জোর গলায় জানিয়েছিল যে, বাঘটা আবার ফিরে আসবে, একটু বেশি রাত্রে আসবে–মরা গরুটাকে যদি এইখানে ঠিক ওইভাবে ফেলে রাখা হয় এবং সারাদিন আশপাশে মানুষের হৈচৈ বন্ধ থাকে।
গরুর শোকে কাতর লক্ষণ জিজ্ঞাসা করেছিল, বার বার বলছ যে, হৈচৈ হলে বাঘটা এসবেনি। তার মানে কি রে বাবা? গা-সুদ্ধ লোকের চলাফিরা রাধাবাড়া বন্ধ রইবে?
ঈশ্বর বলেছিল, বন্ধ রইবে কেন? এদিকপানে এসে ভিড় করবে না। মরা গরু দেখতে এসে ভিড় করলে মরা বাঘ দেখতে এসে ভিড় করা কপালে জুটবেনি। আশপাশে যারা আছ, একটা দিন একটু আড়ালে আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে কাটিয়ে দেবে। গলা চড়িয়ে বলেছিল, খেয়াল রেখ, হন্যে বাঘ। আজ এসে গরু মেরে গিয়েছে, কাল এসে মানুষের ঘাড় মটকে যাবে।
কয়েকজন মাতব্বর স্থানীয় লোক ঈশ্বরকে কথা দিয়েছিল যে, এদিকে কেউ যাতে উকিঝুঁকি দিতেও না আসে, সেটা তারা সামাল দেবে। বাঘটাকে মারার ব্যবস্থা হোক।
তাহলে সবাই ভাগো। বাঘটাকে আগে মারি, তারপর নাতিনাতনি নিয়ে এসে ভিড় জমিও।
অল্পক্ষণের মধ্যে প্রায় জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল এলাকাটা।
ঈশ্বরের পরামর্শে মাচা বাঁধার হাঙ্গামাও করা হয় নি। সমারোহ করতে গেলেই এ বাঘের আর পাত্তা মিলবে না।
রাত্রি হলে লক্ষণের দাওয়ায় এসে তারা বন্দুক বাগিয়ে চুপচাপ বসে থাকবে বাঘটা এলেই জ্বলবে টর্চ, চলবে গুলি।
রবার্টসন বলেছিল, শের যব নাহি আয়েগা, তুমকো হাম গুলি করেগা।
তার কথার ধরনে বড়ই বিরক্ত হয়েছিল প্রভাস।
মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ব্যবহার করতে শেখো নি রবার্টসন? ঈশ্বরের একটা কথায় পাঁচ-ছ শ লোক ভিড় ভেঙে চলে গিয়েছিল খেয়াল আছে?
রবার্টসন বলেছিল, সরি।
রবার্টসন সংযত ছিল। বিকাল থেকে মোটে দেড় পেগ। এ তো সকলেরই জানা কথা যে, এলকোহল লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দেয়।
তার রাইফেলের গুলিতেই বাঘটা মরেছে নিশ্চয়। আর সংযমের প্রয়োজন নেই। পকেট থেকে বার করে বেঁটে মোটা চ্যাপ্টা শিশিটা সে গলায় কাত করে দেয়।
তারপর সে-ই যেন প্রথম আবিষ্কার করে যে, ওটা বাঘ নয়, বাঘিনী। হো-হো শব্দ করে সে হাসে। প্রভাস বিরক্ত হয়ে সিগারেট ধরিয়ে ইংরেজিতে বলে, তাতে কি? জান না যে, বাঘের চেয়ে বাঘিনীর দাপট বেশি হয়? গ্রামের মধ্যে এসে বেড়া ভেঙে গরুটাকে মেরেছিল। পায়ের দাগ দেখেই ঈশ্বর আমাদের বলেছিল যে, এটা বাঘিনী, সম্ভবত বাচ্চা আছে, খিদের জ্বালায় গভীর রাতে ওই গরুটার জন্য ফিরে আসবে। বেন তা করে মেরেছিলাম বলে, নইলে সবাই আমরা মজা টের পেতাম।
হাসি বন্ধ করে রবার্টসন তার কথা শুনছিল, আবার হো-হো করে হেসে উঠে সে বলে, তোমার গুলিতে বাঘ মরেছে? মাঝরাতে স্বপ্ন দেখ না প্রিয় বন্ধু।
এত বড় একটা বাঘ মারার আনন্দে দিশেহারা রবার্টসন আবার দামি বিলিতি মদের শিশি গলায় কাত করে। রবার্টসন নির্জলা উগ্ৰ মদ পান করে কিন্তু হঠাৎ যেন চড়া আনন্দের নেশায় আত্মহারা হয়ে পাগলামি শুরু করে দেয় তাদের ভাড়া করা আমাদের দেশী শিকারি ঈশ্বর।
প্রভাস ও রবার্টসনের অস্তিত্ব ভুলে হঠাৎ সে গিয়ে বাঘিনীটার গায়ে এক লাথি কষিয়ে দেয়, দোনলা দেশী বন্দুকটার কুঁদো দিয়ে গায়ে আঘাত করতে করতে বলে, কিগো সোনামণি, আর এসবি সোনাতলায় ইয়ার্কি দিতে?