গনি সাহেব বড় জামাইকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বাবুর দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, বাবু, কী হয়েছে?
কিছু হয় নাই।
গ্লাস ভেঙেছ কেন?
ওরা শুধু আমাকে বিরক্ত করে।
কি করে?
ঠাণ্ডা পানি চেয়েছিলাম দেয় নাই।
তুমি নিজে ফ্ৰিজ খুলে ঠাণ্ডা পানি নিলে না কেন? বোতল তো পানি ভর্তি থাকে। যাও ফ্রিজ থেকে পানি নিয়ে খাও।
বাবু শান্ত ভঙ্গিতে উঠে গিয়ে ফ্রিজ খুলল। গনি সাহেব অফিসে ফিরে গেলেন। এল-সির ফাইল ভালোমতো দেখতে হবে। একটা ঝামেলা আছে। সূক্ষ্ম একটা ফাঁক। সেই ফাঁকটা কী? বের করতে হবে। বসতে হবে ঠাণ্ডা মাথায়।
সপ্তাহে একদিন মিজান সাহেব
সপ্তাহে একদিন মিজান সাহেব লীনা ও বাবলুকে নিয়ে পড়াতে বসেন। দিনটা হচ্ছে বৃহস্পতিবার। গত সপ্তাহে তিনি পড়ানোর কাজটি করেন নি। বাবলুর মনে ক্ষীণ আশা—হয়ত আজও পড়াবেন না। বাসার পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। ভাইয়া এখনো ফেরে নি। তার কোনোরকম খোঁজও নেই। বড় আপা ঐ রাতের ঘটনার পর কারো সঙ্গে কথা বলছে না। মার শরীরও খুব খারাপ। এখন বেশিরভাগ সময় বিছানাতেই থাকেন। এ রকম একটা অস্বাভাবিক পরিবেশে বাবা নিশ্চয়ই বই নিয়ে পড়াতে বসবেন না। তবু বাবলুর বুক ধকধক করছে। সন্ধ্যা মিলানোর আগেই হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসে গেছে। পড়ছে খুব উঁচু গলায়, যাতে বাবা ধারণা করে নেন পড়াশোনা তো ভালোই হচ্ছে।
বাবলু এবার ক্লাস সেভেনে উঠেছে। তার রোল নাম্বার চার। ধর্ম পরীক্ষায় সে একশতে মাত্র চল্লিশ পেয়েছে বলে এই অবস্থা হয়েছে। ধর্ম স্যার কেন জানি বাবলুকে দেখতে পারেন না। ধর্ম মৌখিক পরীক্ষায় তাকে পচিশের মধ্যে মাত্র পাঁচ দিয়েছেন অথচ সে ধর্মের পাঁচটি ভিত কী বলেছে, এশার নামাজের নিয়ত বলেছে, কুলহুআল্লা সুরা বলেছে, চার সাহাবাদের নাম বলেছে। শুধুবী কত বৎসর বয়সে নবুয়ত পেয়েছেন এটা বলতে পারে নি। দুঃখের ব্যাপার হল এটা বলতে না পারার জন্যে স্যার তাকে একটা চড় মারলেন। পরীক্ষার সময় কেউ কিছু না পারলে কি চড় মারা ঠিক? বাবলু অনেক ভেবেও বের করতে পারে নি কেন ধর্ম স্যার তাকে দেখতে পারেন না। তার অপরাধটা কী? সে তো ক্লাসে কোনো গণ্ডগোল করে না। হৈ-চৈ করে না বা হেড স্যারকে অন্যদের মতো হেড়ু বলে না।
বাবলুর ধারণা বাবাও তাকে দেখতে পারেন না। বৃহস্পতিবারে পড়তে বসা মানেই মার খাওয়া। অথচ সে সব প্রশ্নের উত্তর জানে। সে যদি না জেনে মার খেত তাহলেও একটা কথা ছিল। বাবলু ঠিক করে রেখেছে আর একটু বড় হলেই সে ভাইয়ার মতো পালিয়ে যাবে।
বাবলুর সামনে লীনা বসে আছে। তার মুখও ফ্যাকাশে। সে একটু পর পর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। ঘড়িতে কোনোক্ৰমে আটটা বেজে গেলে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে। আটটার পর বাবা আর পড়াতে বসেন না।
লীনা এ বছর ক্লাস টেনে উঠেছে। পড়াশোনায় সেও ভালো। যদিও পরীক্ষায় ভালো করতে পারে না। পরীক্ষার হলে বসলেই তার হাত কাঁপে। যে জিনিসটা জানা আছে। তাও লিখতে পারে না। লীনা ফিসফিস করে বলল, বাবা বোধ হয় আজ পড়াবে না। তাই নারে বাবলু? আটটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট।
বাবলুর মুখে আনন্দের একটা আভা খেলে গেল। ঠিক তখন মিজান সাহেব ডাকলেন, লীনা। লীনার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। সে ক্ষীণ স্বরে বলল, জ্বি।
বীণাকে বল আমাকে এক কাপ আদা চা দিতে।
লীনার মুখে রক্ত ফিরে এল। এটা খুবই ভালো লক্ষণ। বাবা চা খাবেন—চা খেতেখেতে আটটা বেজে যাবে। খবরের টাইম হয়ে যাবে। তিনি আধা ঘন্টা খবর শুনবেন তারপর ভাত খাবার সময় হয়ে যাবে। লীনা বীণাকে চায়ের কথা বলতে গেল। যাবার আগে বাবলুর দিকে তাকিয়ে আনন্দের হাসি হাসল।
এমনিতেই বাবার সঙ্গে বীণার তেমন কথাবার্তা হয় না। ঐ রাতের ঘটনার পর কথাবার্তা একেবারেই বন্ধ। শুধু কথাবার্তা না, বীণা বাবার দিকে মুখ তুলে তাকায়ও না। মিজান সাহেব যতক্ষণ বাসায় থাকেন ততক্ষণ বীণা হয় তার নিজের ঘরে কিংবা রান্নাঘরে থাকে।
অন্ধকার বারান্দায় মিজান সাহেব চুপ করে বসে আছেন। বীণা বাবার পাশে চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল। মিজান সাহেব দেখলেন বীর হাতে ঘড়ি নেই। কয়েকদিন ধরেই তিনি ব্যাপারটা লক্ষ করছেন। বীণা তার বাবার দেয়া ঘড়ি পরছে না। একবার জিজ্ঞেস করা যায় না কেন?
মিজান সাহেব চা শেষ করে শীতল গলায় বললেন, লীনা বাবলু বই নিয়ে আয়।
বীণা মার জন্যে সাগু বানাচ্ছিল। বাবলু পাংশু মুখে পাশে এসে দাঁড়াল। ফিস ফিস করে বলল, আপা, বাবা আমাকে মারবে।
মারবে কেন?
অঙ্ক বই হারিয়ে ফেলেছি আপা।
আজ অন্য পড়া পড়। অঙ্ক না কালি।
যদি অঙ্ক করতে বলে?
বীণা উত্তরে কিছু বলতে পারল না। বারান্দা থেকে মিজান সাহেব কঠিন গলায়। বললেন, বাবলু রান্নাঘরে তুই কী করছিস? এদিকে আয়।
বাবল অঙ্ক বই হারিয়ে ফেলেছে এটা কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরা পড়ল। শুধু অঙ্ক বই না, সে জ্যামিতি বাক্সও হারিয়ে ফেলেছে। জ্যামিতি বাক্স হারিয়েছে দশ দিন আগে। বাবলু ভয়ে কাউকে কিছু বলে নি।
মিজান সাহেব বাবলুকে নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকলেন। ফরিদাকে বললেন, তুমি একটু বাইরে যাও। কোন কথা বলবে না। বাইরে যেতে বলছি বাইরে যাও। ফরিদা শুকনো মুখে বের হয়ে এলেন। মিজান সাহেব দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে দিলেন। কঠিন শাসনের সময় তিনি সাধারণত বাতি নিভিয়ে দেন।
রান্নাঘরের কাজ ফেলে বীণা বন্ধ দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ফরিদা জলচৌকিতে বসে আছেন। লীনা এখন চোখের সামনে বই ধরে আছে। তার মুখে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। সে অল্প অল্প কাঁপছে। তার ইচ্ছা করছে দৌড়ে দাদীর কাছে চলে যেতে। আবার কেন জানি সে সাহসও হচ্ছে না। দাদীকেও সে খানিকটা ভয় করে।