ফরিদা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, মেয়ে বড় হয়েছে, মারধোর করবে না।
যা করতে বলছি, কর।
বীণা মাথা নিচু করে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আতঙ্কে তার মুখ নীল। মিজান সাহেব স্ত্রীকে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। পরবর্তী কিছু সময় পর্যন্ত মিজান সাহেবের কোনো জ্ঞান ছিল না। যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখলেন বীণা মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে, তার ঠোঁট কেটে গলগল করে রক্ত পড়ছে। ফরিদা প্রাণপণে দরজা ধাক্কাচ্ছেন। বাবলু ও লীনা চিৎকার করে কাঁদছে। এক সময় মিজান সাহেব দরজা খুললেন। কারো মুখে কোনো কথা নেই শুধু লীনা ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে বলল, আপা মরে গেছে। ও আম্মা, আপা মরে গেছে।
রাত প্রায় দুটোর মতো বাজে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। মিজান সাহেব ঘুমান নি। জলচৌকির উপর বসে আছেন। বারান্দায় বাতি নেভানো। তবু বারান্দা পুরোপুরি অন্ধকার হয় নি। আকাশে চাঁদ আছে। তার ক্ষীণ আলোয় সব কিছুই ম্লানভাবে নজরে আসে।
মিজান সাহেব জলচৌকি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। নিঃশব্দে তার ঘরের জানালার সামনে এসে দাঁড়াতেই বৃদ্ধা বললেন, কী চাসরে মিজান?
মিজান সাহেব বললেন, বীণা কি ঘুমুচ্ছে?
হ ঘুমাইতেছে। তুই কামটা কী করলি?
তিনি জবাব দিলেন না। বৃদ্ধা বললেন, তোর মাথাটা খারাপ হইছে। তুই একটা তাবিজ কবচ নে। একটা ডাক্তার দেখা। তোর মইদ্যে আমি মাথা খারাপের লক্ষণ দেখি।
তিনি চুপ করে রইলেন। তাঁর খুব ঘরে ঢোকার ইচ্ছা হচ্ছিল। ঢাকা সম্ভব নয়। দরজা খুলতে হলে বীণাকে জাগাতে হবে। বীণাকে জাগাতে ইচ্ছা করছে না।
বৃদ্ধা বললেন, ভিতরে আয় দরজা খোলা।
তিনি ভেতরে ঢুকলেন।
বৃদ্ধা বললেন, এক কাম কর। মেয়ের মাথায় হাত দিয়া মনে-মনে মেয়ের কাছে। মাফ চা। মাফ না চাইলে তুই মনে শান্তি পাইবি না। আর এর মধ্যে দোষের কিছু নাই।
মিজান সাহেব এগিয়ে এসে মেয়ের পিঠে হাত রাখলেন।
ও মিজান।
কি?
মেয়েটার বিয়া দে। তার কাছে মেয়েটা কষ্ট পাইতেছে।
মিজান সাহেব জবাব দিলেন না। তাঁর চোখে পানি এসে গেছে। তিনি লজ্জিত বোধ করছেন। ঘর অন্ধকার নয়ত আরো বেশি লজ্জা পেতেন। অবশ্যি আলো থাকলেও তাঁর মা তাকে দেখতে পেতেন না।
ও মিজান।
কি?
যা ঘরে যা। ঘরে গিয়ে ঘুমা।
মিজান সাহেব বের হয়ে এলেন। তিনি অবশ্যি জানতে পারলেন না যে বীণা ঘুমায় নি। জেগেই ছিল। জানলে তাঁর কেমন লাগত কে জানে।
ওসমান গনির অফিস ঘর
ওসমান গনির অফিস ঘরটি ছোট। তাঁর সামনে একটি মাত্র চেয়ার। তিনি একসঙ্গে বেশি মানুষের সাথে কথা বলতে পারেন না। এক জনের সঙ্গে কথা বলেন। আজ মিজান সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু মিজান সাহেব এখনো এসে পৌঁছান নি। গনি সাহেব হাতে ঘড়ি পরেন না। তাঁর এই ঘরে কোন ঘড়িও নেই। তবু তিনি জানেন যে এগারটার উপর বাজে।
তাঁর সেক্রেটারি মজনু মিয়া বলল, উনি কয়েকদিন ধরেই দেরি করে অফিসে আসছেন। পরশু এসেছেন লাঞ্চ টাইমের পরে।
গনি সাহেব হাসিমুখে বললেন, উনি দেরি করে আসছেন না সময়মত আসছেন। এই খোঁজ নেবার জন্যে তো আমি তোমাকে বলি নি বলেছি? তোমাকে বলেছি তাঁকে খবর দিতে। তুমি তাকে পাও নি। ব্যাস ফুরিয়ে গেল। ইতং বিতং এত কথা কেন? বেশি বলা ভালো না মজনু মিয়া। কথা বলবে কম। কাজ করবে বেশি বুঝতে পারলে?
জ্বি স্যার।
এখন আমার সামনে থেকে যাও। কাজ কর।
মজনু মিয়া বিরস মুখে বের হয়ে গেল। তাকে কাজ করতে বলা হয়েছে অথচ তার হাতে কোনো কাজ নেই। কখনো ছিল না। তার টেবিল ফাইলশূন্য।
বড় সাহেবের ফাইলপত্রে সেক্রেটারির খানিকটা অধিকার থাকে। মজনু মিয়ার কিছুই নেই। গনি সাহেব সমস্ত ফাইল নিজে দেখেন। চিঠিপত্র ড্রাফট নিজে করেন। টেলিফোনটিও তাঁর ঘরে। সেক্রেটারি হিসেবে মজনু মিয়া যে টেলিফোন প্ৰথমে ধরবে সেই সুযোগও নেই। মজনু মিয়া তার গদি আটা চেয়ারে কাত হয়ে বসে থাকে এবং ভাবে কেন অকারণে গনি সাহেব বেতন দিয়ে তাকে পুষছেন। মাঝেমাঝে এই চাকরি ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করে। বাজার খারাপ। চাকরি ছেড়ে দিলে নতুন কিছু জোগাড় করা সম্ভব না। গনি সাহেব মালিক হিসেবে ভালো। দুই ঈদে বোনাসের ব্যবস্থা আছে। কট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কর্মচারী কল্যাণ তহবিল খুলেছেন। এক জন ডাক্তারের এ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছেন। এই ডাক্তার সপ্তাহে তিনদিন আসেন এবং এক ঘন্টা থাকেন। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী যে সব ওষুধ কেনা হয় তার অর্ধেক দাম কোম্পানি দেয়।
তার চেয়েও বড় কথা কোম্পানি বড় হচ্ছে। গনি সাহেব শিপিং বিজনেস শুরু করতে যাচ্ছেন এ রকম কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে। অবশ্যি গনি সাহেব সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। তাঁর সম্পর্কে যা শোনা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় না। গনি সাহেব এক ঘন্টা ধরে গভীর মনোেযোগ ফাইলপত্র দেখছেন। বিদেশে এলসি। বিষয়ক ফাইল। তাঁর ভ্রূ কুঞ্চিত। একটা কিছু ঠিকমতো হয় নি বলে তাঁর মন বলছে, কিন্তু সেটা কী তা ধরতে পারছেন না। কর্মচারীদের কাউকে তিনি অবিশ্বাস করেন না আবার বিশ্বাস করেন না। তাঁর কাছে সব সময় মনে হয় মানুষ এমন একটা প্রাণী যাকে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনোটাই করা যায় না।
স্যার আসব?
গনি সাহেব ফাইল বন্ধ করে বললেন, আসুন, আসুন। বসুন। কেমন আছেন? মিজান সাহেব সঙ্কুচিত গলায় বললেন, ভালো। তিনি ভেবেছিলেন গনি সাহেব তাঁর দেরি করে আসার ব্যাপারে কোনো কৈফিয়ত তলব করতে পারেন। আগে একদিন তাঁকে খোঁজ করে পান নি। কিন্তু গনি সাহেব কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। হাসিমুখে অন্য প্রসঙ্গ তুললেন, আপনার ছেলের খোঁজ পাওয়া গেছে?