আজ ঘুম ভাঙামাত্র অভ্যাস মতো হাত বাড়িয়ে টেলিফোন রিসিভার টেনে আনল। চোখ বন্ধ করে ছটা নাম্বার ডায়াল করল। রিং হচ্ছে কেউ ধরছে না। পাঁচবার রিং হবার পর অলিক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে টেলিফোন নামিয়ে রাখল। দরজা খুলে ময়নার মাকে বলল, চা এবং কিছু খাবার দিতে।
ময়নার মা ভয়ে-ভয়ে বলল, আপনের কাছে কে এক জন আসছে। অনেকক্ষণ হইছে।
ছেলে না
মেয়ে? মেয়ে।
আগে কখনো এ বাড়িতে এসেছিল?
না।
তাহলে চলে যেতে বল।
উনার নাম বীণা বলছে আপনের বন্ধু।
চলে যেতে বল। বীণা নামের কাউকে আমি চিনি না। গায়ে কাপড় কী? শাড়ি না কামিজ?
শাড়ি।
শাড়ির রঙ কি?
সাদার মধ্যে নীল ফুল।
বড় বড় ফুল না ছোট ছোট ফুল?
ময়নার মা মনে-মনে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। এই আপা বড় যন্ত্ৰণা করে। মাথা খারাপ করে দেয়।
মেয়েটার চেহারা কেমন?
সুন্দর।
আমার চেয়েও সুন্দর?
অত জানি না আফা। আপনেও সুন্দর উনিও সুন্দর।
অলিক নিচে নেমে এল। মেয়েটি যদি সুন্দর হয় তাহলে এক নজর দেখা যেতে পারে। সে মনে-মনে বলল-I Loved a love once, fairest among women, closed her doors on me, I must not see her, এই কবিতাটা সে গত সপ্তাহে মুখস্থ করেছে। প্রতি সপ্তাহে সে একটা করে কবিতা মুখস্থ করার পরিকল্পনা করেছে। এই সপ্তাহে সুইনবার্নের কবিতা মুখস্থ করার কথা। এখনো কবিতা সিলেক্ট করা হয় নি।
আরে বীণা তুই?
অলিক প্রায় ছুটে গিয়ে বীণাকে জড়িয়ে ধরল। এবং সেখানেই থেমে থাকল না, বীণাকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল সোফায়, তবুও ছাড়ল না। গাঢ় গলায় বলল, তুই আমার ঠিকানা পেলি কোথায়?
মালবী দিয়েছে।
তোর কথা আমি কত ভেবেছি। বিশ্বাস কর।
দম বন্ধ হয়ে আসছে। হাত ছাড়।
না ছাড়ব না। I loved a love once, I must not see her.
তুই আগের চেয়েও পাগল হয়েছিস অলিক।
অলিক হাত ছেড়ে দিল এবং গম্ভীর হয়ে বলল, একটা খবর আছেরে বীণা মা মারা গেছে।
সে কী?
I was so happy, খুবই আনন্দ হয়েছিল।
চুপ কর।
সত্যি কথা বলছি বীণা। মার মৃত্যু আমার জন্যে আনন্দের ছিল।
বলতে বলতে অলিকের চোখে পানি এসে গেল। বীণা অবাক হয়ে বান্ধবীকে দেখছে। কি সুন্দর হয়েছে অলিক। চোখ ফেরানো যায় না, এমন সুন্দর। স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। গায়ের রঙ হয়েছে আরো উজ্জ্বল। চোখ দুটি গভীর কালো। কালো চোখে পানি টলমল করছে। যেন তুলিতে আঁকা ছবি।
অলিক, শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে খুবই সহজ গলায় বলল, মাকে পুরো এগার মাস কষ্ট করতে দেখলাম। সে যে কী অমানুষিক কষ্ট—তুই বিশ্বাস করতে পারবি না। মনে হচ্ছে জীবন্ত একটা প্রাণীর গা থেকে টেনে চামড়া ছাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে।
চুপ কর। শুনতে চাই না।
না তোক শুনতে হবে। শেষ কমাস মা শুধু বলত, তোমাদের পায়ে পড়ি, তোমরা আমাকে মেরে ফেল। প্লিজ প্লিজ।
আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। বুঝলি, একদিন সত্যি-সত্যি মার জন্য বিষ। কিনতে গেলাম। নিউ মার্কেটের একটা ওষুধের দোকানে। দোকানদার ভাবল আমি বোধহয় পাগল।
খালার কী হয়েছিল? কেউ জানে নাকী চামড়া নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। বিলেতের ডাক্তাররা বললেন, এ রেয়ার স্কিন ডিজিজ। গায়ের পুরো চামড়া পাল্টে নতুন চামড়া লাগালেই শুধু ঠিক হবে। বীণা তুই আসায় আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার কথা বলার কেউ নেইরে। আয় আমার ঘরে আয়। আমার সঙ্গে ভাত খাবি।
এখন ভাত খাব কী? পাঁচটা বাজে।
আমি দুপুরে খাই নি, বড় ক্ষিদে লেগেছে। আয় বীণা, না করি না। না বললে আমার খুব খারাপ লাগবে। I might cry.
বীণা অলিককে তার পাশের খবর দিতে এসেছিল, সে তার কোন সুযোগ পেল না। অলিক অনবরত কথা বলছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে বলছে, কথা বলার লোক পা না বীণা। এই জন্যে এত কথা বলছি। রাগ করছিস না তো?
না, রাগ করছি না।
আচ্ছা তোর ঐ দাদী, এখন বেঁচে আছেন? ঐ যে একবার দেখতে গেলাম। পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। তুই পরিচয় করিয়ে দিলি-দাদী, আমার বান্ধবী। আর উনি আমাকে বললেন, ম হারামজাদী।
বীণা অপ্ৰস্তুত গলায় বলল, উনার মাথার ঠিক নেই অলিক।
সেই জন্যেই তো উনাকে আমার এত পছন্দ। আমারো মাথার ঠিক নেই। উনি কি এখনো বেঁচে আছেন?
হ্যাঁ।
জানতাম বেঁচে আছেন। পাগলরা দীর্ঘজীবী হয়। আমিও অনেকদিন বাঁচব।
অলিক সত্যি-সত্যি পাগলের মতোই হাসতে লাগল। বীণা বলল, তোর স্বভাবচরিত্র এতটুকু বদলায় নি। আগে ইংরেজিতে কবিতা লিখতি, এখনো লিখিস?
অলিক জবাব দিল না। ঠোঁট টিপে হাসছে। নিশ্চয়ই কিছু ভাবছে।
এই অদ্ভুত মেয়েটা বীণাদের কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে এসে ভর্তি হল। চশমা চোখের রোগা লম্বা একটি ধারাল চেহারার মেয়ে। কেমন যেন জড়ানো গলায় কথা বলে। কথা বলার সময় স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে। একবারও চোখের পাতা ফেলে না। প্রথম দিনেই তার নাম হয়ে গেল সর্পরাণী। কারণ সাপ চোখের পাতা ফেলে না–সাপের চোখের পাতা নেই।
সপ্তাহখানেক পর একদিন টিফিন টাইমে বীণা টিফিন খাচ্ছে, অলিক এসে উপস্থিত। চোখে পলক না ফেলে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে বলল, তোমাকে আমি বন্ধু হিসেবে নিলাম। কারণ একমাত্ৰ তুমিই আমাকে সৰ্পরাণী বল নি আর সবাই বলেছে।
বীণা কী বলবে বুঝতে পারল না। অলিক তার পাশে বসে সহজ স্বরে বলল, এখন আমরা বন্ধু হয়েছি। কাজেই আমি আমার জীবনের একটি গোপন কথা তোমাকে বলব। আর তুমি বলবে তোমার জীবনের গোপন কথা। ঠিক আছে?
বীণা হকচকিয়ে বলল, আমার জীবনের কোনো গোপন কথা নেই।